Thursday, April 20, 2017

শক্তিপ্রতীক - ৩ (Power-worship : Shakti Symbol-3)

<Previous--Contents--Next>

4.3) শক্তিপ্রতীক : নারী

(Power-symbol : Woman)

সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরেরও পূর্বের কথা - ইতিহাসের তখন জন্মই হয় নাই । - তবে কালনিৰ্ণয় আর করিবে কে ? জগতের সেই প্রাচীন যুগের অতি প্ৰাচীন কাহিনী সম্বন্ধে ইউরোপের বর্তমান কালের পুরাণজ্ঞ সূতকুল (antiquarian researchers) এই কথা বলিয়া থাকেন ।

বর্বর জগৎ তখন অজ্ঞানপ্ৰসূত নিবিড় অমানিশা সমাচ্ছন্ন । যে দিকে যতদূর দেখ, তমঃশক্তির সহিত রজঃশক্তির ঘোরতর দ্বন্দ্ব চলিয়াছে । মানবের মাসংপিণ্ডময় স্থূল দেহাপেক্ষা সমধিক শ্রেষ্ঠশক্তিসম্পন্ন অথচ তদন্তৰ্গত মনের ন্যায়, বহিঃপ্রকৃতির স্থূল সৃষ্টির অন্তৰ্গত শ্ৰেষ্ঠ সৃষ্টি - মানব-মানবীকে অধিকার করিয়াই পূৰ্বোক্ত দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে প্ৰকাশিত । প্ৰথম ক্ষুধার তাড়না, দ্বিতীয় অত্যধিক শীত, বাত, উষ্ণতাদি ও বন্য পশ্বাদির হস্ত হইতে আপনাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা, তৃতীয় আসঙ্গলিপ্সা, প্রভৃতি নানা প্রেরণায় মানব-মানবীর অন্তর্নিহিত রজোগুণ ক্রমশঃ বিশেষভাবে উদ্ধুদ্ধ এবং জীবন সংগ্রামে জয়ী হইতে লাগিল । আহারের নিমিত্ত ফলমূল অন্বেষিত হইল; যখন তাহা জোটা কঠিন হইল, তখন পশুবধ ও মাংসভোজন চলিতে লাগিল । গিরিগুহা, মৃৎস্তূপাদির সন্ধান এবং পরে শীত নিবারণ ও বাসের জন্য তদনুকরণে পর্ণাচ্ছাদন রচিত হইল হে দেবি মানবি ! - তমোগুণময়ী হইয়া আত্মস্বরূপ প্ৰকাশিত করিলেও তখন হইতেই তুমি সেই বর্বর নরের সহচরী !

ক্ৰমে অনিশ্চিত খাদ্যসঞ্চয়কে আয়ত্তাধীনে রাখিবার জন্য পশুপালন বৃত্তির প্রারম্ভ । মানবকুল তখন পূৰ্বাপেক্ষা অনেক বিস্তৃত - কিন্তু ঐ বিস্তারে এখনকার ন্যায় বিবাহ প্রথার নামগন্ধও নাই । আসঙ্গলিপ্সাই সে সম্মিলনে প্ৰজাপতি, কামই পুরোহিত এবং ছল-বল-কৌশলাদিই উহার মন্ত্র তন্ত্র । উহার কতকাল পরেও ‘দেবরেণ সুতোৎপত্তিঃ’ প্ৰভৃতি নিয়মে, এবং অতিবৃদ্ধ মনুর নয় প্রকারের বিবাহ এবং নয় প্রকার পুত্রের কথা লিপিবদ্ধ করাতেই পূর্বোক্ত বিষয় প্রমাণিত । নূহ বংশীয় লটের দুহিতাদ্বয় অপর পাত্রের অভাব দেখিয়া পিতাকেই মধুপানে মত্ত করিয়া গৰ্ভধারণ করিলেন ! [Genesis, XIX. 30-38] ঐরূপ আরও কত বিসদৃশ সম্মিলনে যে মানবকুলের প্রথম বিস্তৃতি, কে তাহার ইয়ত্তা করিবে ? নিত্য নিৰ্বিকার ঈশ্বর ভিন্ন, সে সকল বিপরীত সন্মিলন সম্মুখে দেখিলে আমাদের ন্যায় সামান্য জীবের কাহার মন না অসীম লজ্জা ও ঘৃণায় ম্রিয়মাণ হইয়া সমগ্ৰ মনুষ্যজাতিকেই শত ধিক্কার প্রদান করিবে !

এইবার এক প্রকারের স্বার্থচেষ্টা মানবকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দলবদ্ধ করিতে লাগিল । বন্য পশুকুল স্বজাতির সহিত একত্ৰ দলবদ্ধ থাকায় পরস্পরের কত সহায় হয় দেখিয়া এবং একাকী অপর বর্বর মানব ও হিংস্ৰ শ্বাপদকূলের হস্ত হইতে নিজ সহচরী ও পশু প্ৰভৃতিকে রক্ষা করিতে যাইয়া বারবার ক্ষতিগ্ৰস্ত হইয়া মানব বুঝিল - একত্র চেষ্টায় বলবৃদ্ধি, একত্ৰ বাসে বিশেষ লাভ । তখন মানব ক্রমশঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডলীতে আপনাকে নিবদ্ধ করিল; এবং মণ্ডলীর অন্তৰ্গত ব্যক্তি সকলের একত্র পশুচারণ, এবং রাত্রিকালে একই স্থানে পশু বন্ধন করায় একত্ৰ বাসের প্রথা প্ৰচলিত হইল । মণ্ডলীমধ্যগত সৰ্বাপেক্ষা বলবুদ্ধিশালী পুরুষের অন্য সকলের উপর প্ৰভুত্ব বিস্তৃত হইল এবং তাহারই নামে ঐ মণ্ডলী সর্বত্র পরিচিত হওয়াতে ‘গোত্ৰ’ সকলের উৎপত্তি হইল । গোত্ৰস্থ প্ৰত্যেক নারীই তখন গোত্রপতির বিশেষভাবে এবং গোত্ৰ মধ্যগত অপর সকল পুরুষের সমভাবে উপভোগের পদাৰ্থ বলিয়া পরিগণিত হইল । এইরূপে গোত্রের সহিতই নারীর প্রথম বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপিত হইল । দ্রৌপদীরূপিণী নারী তখন এককালে শত পতির মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত হইলেন ! অসহায় একক নরের সমসুখদুঃখভাগিনী পূৰ্বসহচরী তখন মণ্ডলী-বলপুষ্ট দর্পিত মানবের পাশবপ্রবৃত্তি-চরিতার্থ কুশলা পরাধীন দাসীমাত্রে পরিণত হইলেন ।

তখন গোত্ৰসকল আবার পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিল । এক গোত্র অপর গোত্রের নারী ও গোধন যখনই পারিল, ছলে বলে আত্মসাৎ করিতে লাগিল, এবং কখন বা যুদ্ধবিগ্রহে অপর গোত্ৰস্থ সকল পুরুষের নিধন সাধন করিয়া, তাহাদের যাবতীয় নারী ও পশু অধিকার করিয়া বসিল । ঐ রূপে অনেক গোত্রের নাম পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গেল ! অসহায়া অবলা নারী তখন বলবান মানবহস্তের ক্রীড়াপুত্তলি হইলেন । - দেবরাজ্ঞী শচীর ন্যায়, যখন যে ইন্দ্ৰত্ব লাভ করিল, হাস্যমুখে তাহারই বামে তখন উপবেশন করিয়া তাহারই মনোরঞ্জনে প্ৰবৃত্ত হইলেন !

এইবার পশুকুলের পালন ও খাদ্যসংগ্রহে সদলবলে দূরসঞ্চারী গোত্ৰকুল পশুপ্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হইল । এইরূপে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমশঃ বিস্তার হইয়া নিয়ত-পর্যটনশীল অনিশ্চিতাবাসস্থান মানবমণ্ডলীসকলকে বিশেষ বিশেষ জনপদে আবদ্ধ করিয়া ফেলিল । পল্লীগ্রামসমূহের উৎপত্তি হইয়া ক্ৰমে দেশসকলের সূচনা হইল । কিন্তু মানবের অবস্থার উন্নতি হইলে কি হইবে ?  হে দেবি মানবি, তোমার অবস্থার পরিবর্তন হইল না । দাসী দাসীই রহিল । পশু প্ৰভৃতি ধনের ন্যায় সৌন্দর্যভূষিতা নারী পাশব-বলদৃপ্ত মানব-প্রভুর অন্যতম রত্নমধ্যেই পরিগণিতা রহিলেন ।

ক্ৰমে বহু গোত্ৰসমূহ একই স্বার্থচেষ্টায় একত্র মিলিত হইয়া, ‘সুমের’ জাতির অভ্যুদয় এবং কালে বাবিলে সাম্রাজ্য স্থাপন । দমুজি ও আদুনেইয়ের পূজা প্রচারে সকাম প্রবৃত্তিমার্গের পূজার চূড়ান্ত অভিনয় ! জীবসৃষ্টিতে প্রয়োজনীয়তা নিত্য প্রত্যক্ষ করিয়া তন্ত্রশাস্ত্ৰে ‘পিতৃমুখ ও মাতৃমুখ’ স্বরূপে বর্ণিত যোনি ও লিঙ্গের উপাসনা-পদ্ধতি প্ৰবর্তিত হইল ! দেবীমন্দিরে পূর্বাপরিচিত পুরুষাঙ্কে শয্যা লাভ করা রূপ নারীর বিবাহপ্রথা প্ৰচলিত হইল !

নিয়ন্ত বর্ধমান ‘সুমের” জাতিরই এক ভাগ ক্ৰমে বাসের জন্য ‘সুজলা সুফলা’ ভূমিবিশেষের অন্বেষণে নিৰ্গত হইয়া স্ত্রী-পুং-চিহ্নের উপাসনাদি লইয়া ভারতে প্ৰবেশ করিল । অনেক কাল সমৃদ্ধিশালী হইয়া ভারতে বাসের পর উহারই এক শাখা আবার মালাবার উপকূল হইতে নৌযানে মিসরে যাইয়া নীলনদীতীরে অপর এক সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের সুচনা করিল ! এইরূপে ধন-ধান্যসম্পদ-গৌরবে পূৰ্বাপেক্ষা মানবের অনেক পদবৃদ্ধি হইল । মানবীর অন্তর্নিহিত দৈবী শক্তিও মানবের স্বীয় অবস্থোন্নতি-প্ৰবৃত্তির উত্তেজিকা হইয়া সর্বকাল সঙ্গে বাস ও তাহার সন্তানসন্ততি ধনজনাদির পালন ও রক্ষণে সহায়তা করিয়া সেই প্ৰাচীন যুগেই পৃথিবীর বহু স্থানে বহুভাবে বহুজন দ্বারা সকাম ভক্তির সহিত পূজিতা ও উপাসিতা হইলেন । সে উপাসনার মূলমন্ত্ৰ-মানবের স্বার্থসুখান্বেষণ, সে দেবীর প্রয়োজন - মানবের ভোগতৃপ্তি পর্যন্ত । কিন্তু ঐ্রররূপ হইলে কি হয় ? দুৰ্গন্ধাবিল পঙ্কাশ্রয়ে মধুগন্ধসমাকুল ফুল্ল দেবভোগ্য শতদলের ন্যায় মানবের ঐ ইন্দ্ৰিয়সুখৈষণা ভোগৈষণা ও আসঙ্গলিপ্সাপূর্ণ সাগ্ৰহ সকাম ভক্তি হইতেই কালে মানবমন নারী প্ৰতিমায় জগদম্বার হ্লাদিনী শক্তির উপাসনা করিতে শিখিল । ত্ৰিজগৎ-প্ৰসবিনী শক্তিকে কালে বিরাট নারীমূর্তি স্বরূপে কল্পনা করিয়া তদবলম্বনে জগন্মাতার উপাসনা করিয়া কৃতাৰ্থ হইতে শিখিল ।

প্ৰবৃত্তির জটিলারণ্যে মানব যখন ঐরূপে দিঙ্‌নির্ণয়ে অসমর্থ হইতেছিল, মানবীর শরীরমনের কমনীয় কান্তিকলায় সম্যগাকৃষ্ট হইয়াও যখন সে তাহার ভিতর “সূর্যকোটিপ্রতীকাশ চন্দ্ৰকোটিসুশীতল” দেবীমূর্তির সাক্ষাৎ পাইতেছিল না, তখন ভারতের দেবকুল দেবদ্রূমপরিশোভিত অভ্ৰভেদী হিমাচলশৃঙ্গে জগতের যাবতীয় নারীশরীরমনের সমষ্টিগঠিতা হৈমবতী উমার উজ্জ্বল কাঞ্চনাগৌরমূর্তির প্রথম সন্দর্শনে ধন্য হইলেন । দেবজগৎ স্তম্ভিতহৃদয়ে বালার্করূপিণী অনন্তকোটি-ব্রহ্মাণ্ডপ্ৰসবিনী ব্ৰহ্মশক্তি দেবী মানবীকে নীলাম্বরে সুখাসীনা দেখিলেন এবং তাঁহারই শ্ৰীমুখ হইতে তাঁহার মহিমাবাণী শ্রবণ করিলেন -

“অহং রাষ্ট্ৰী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাং
    * * *
ময়া সোহান্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্‌ ৷
অমন্তবো মাং ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ৷৷
    * * *
যং যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমি
তং ব্ৰহ্মাণং তমৃষিম্‌ তং সুমেধাম্‌ ৷” - [ঋক্, দেবীসুক্ত]

“আমিই সমগ্র জগতের রাজ্ঞী, আমার উপাসকেরাই বিভূতিসম্পন্ন হয়; আমিই ব্ৰহ্মা এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানসম্পন্না, সকল যজ্ঞে আমারই প্রথম পূজাধিকার; দর্শন, শ্রবণ, অন্নগ্ৰহণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসাদি প্ৰাণিজগতের সমগ্ৰ ব্যাপার আমার শক্তিতেই সম্পাদিত হয়; সংসারে যে কোন ব্যক্তি শুদ্ধভাবে আমার উপাসনা না করিয়া আমার অবজ্ঞা করে, সে দিন দিন ক্ষীণ ও কালে বিনষ্ট হয়; হে সখে, অবহিত হইয়া যাহা বলিতেছি শ্রবণ কর - শ্রদ্ধার দ্বারা যে ব্ৰহ্মবস্তুর সন্দর্শন লাভ হয়, আমিই তাহা; আমার কৃপাতেই লোকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে; আমার কৃপাকটাক্ষেই পুরুষ - স্রষ্টা, ঋষি এবং সুক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।”

দেবকুল হইতেই ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকুলে নারীমূর্তির কামগন্ধহীন পূজার প্রথম প্রচার । উপনিষৎ-প্ৰাণ ঋষি দেবীমহিমা প্ৰাণে প্ৰাণে প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিয়া গাহিলেন -
“অজামেকাং লোহিত শুক্লকৃষ্ণাং
বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ ৷
অজো হ্যেকো জুষমাণোহনুশেতে
জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ ॥”- [শ্বেতাশ্বতর]
“শুক্লকৃষ্ণরক্তবর্ণা সত্ত্বরজাস্তমোগুণময়ী, অনন্যসম্ভবা এক অপূৰ্বা নারী অনন্যসম্ভব এক পুরুষের সহিত সংযুক্ত থাকিয়া আপনার অনুরূপ বহু প্রকারের প্রজাসকল সৃজন করিতেছেন” - ইত্যাদি ।

আত্মস্বরূপে বর্তমান দেবীমহিমা প্ৰত্যক্ষ করিয়াই তিনি শিক্ষা দিলেন - “ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবত্যাত্মনস্তু কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবতি ।” - [বৃহদারণ্যক, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, ৫ম ব্ৰাহ্মণ, ৬]

“জায়ার ভিতরে আত্মস্বরূপিণী দেবী বর্তমানা বলিয়াই লোকের জায়াকে এত প্রিয় বলিয়া বোধ হয় ।”

ঋষিদিগের পদানুসরণে কৃতাৰ্থ হইয়া অতি বৃদ্ধ মনু আবার গাহিলেন -
“দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ ৷
অৰ্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্ৰভুঃ ॥” – [মনুসংহিতা ১-৩২]

সৃষ্টিপূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করিলেন ও সঙ্গত হইলেন । অতঃপর সেই নারী, বিরাট ব্ৰহ্মাণ্ডকে নিজ শরীর বলিয়া বোধ করিতেছেন যে পুরুষ, তাঁহাকে প্রসব করিলেন ।” বলদৃপ্ত মানব এতকাল আপনি সুখের জন্য, আপনি স্বার্থের জন্যই নারীর পালন ও রক্ষণ করিতেছিল; বৃদ্ধ মনু তাহাকে এখন নারীকে সহধৰ্মিণী জ্ঞানে সম্মানের চক্ষে দেখিতে শিখাইয়া তাহাকে নারীপূজায় আর এক পদ অগ্রসর করিলেন ।
“যত্ৰ নাৰ্য্যস্তু পূজ্যন্তে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ ৷
যত্ৰৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সৰ্বাস্তত্ৰাফলাঃ ক্রিয়াঃ ৷৷”
যে গৃহে নারীগণ পূজিত হন, সেই গৃহে দেবতাসকলও সানন্দে আগমন করেন; আর যে গৃহে নারীগণ বহুমান লাভ না করেন, সে গৃহে দেবতাদিগের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কোন ক্রিয়াই সুফল প্রসব করে না ।

এইরূপে ভারতের আর্যগৌরব ঋষিকুলই জগতে নারীমহিমা প্ৰথম অনুভব ও প্রচার করিলেন । সকাম জগৎ নির্বাক ও উদ্‌গ্রীব হইয়া তাঁহদের সেই পুতবাণী শ্রবণ করিল - মোহিতচিত্তে নারীপ্রতীকে কামগন্ধমাত্রহীন মাতৃপূজার, দেবীপূজার, তাঁহাদের সেই আয়োজন দেখিতে থাকিল এবং মুগ্ধ হইয়া তাঁহাদের যথাসম্ভব পদানুসরণ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইল । হে দেবি মানবি ! এইরূপে ভারতই তোমার দেবীমূর্তির নিষ্কাম পূজা জগতে প্ৰথম করিয়া ধন্য হইল - সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করিল ! ভারত সেই দিন হইতেই তোমায় কুলদেবীরূপে গৃহে গৃহে পুজা ও সম্মান করিতে থাকিল ।

সে সম্মান, সে শ্রদ্ধা ও পূজার ফলও ভারত প্ৰত্যক্ষ পাইল । সীতা, সাবিত্রী, দ্ৰৌপদী, দময়ন্তী প্রভৃতি হ্রীসৌন্দর্যভূষিতা উজ্জল দেবীপ্রতিমাসকল সৰ্বাগ্রে ভারতে পদার্পণ করিয়া দেশ পবিত্র করিলেন, পুণ্যময় ধর্মক্ষেত্রে পরিণত করিলেন । হে ভারত-সন্তান, বৈদেশিক অনুকরণে আজ কিনা তুমি নিজ কুললক্ষীর চরিত্র ও জীবন গঠনে অগ্রসর । অস্বাভাবিক শিক্ষা সম্পন্ন হীনবুদ্ধি বর্বর ! তোমার আধ্যাত্মিক দৃষ্টির কি অবনতিই হইয়াছে ! একবার বৈদেশিক মোহের নিবিড়াঞ্জন নয়ন হইতে অপসৃত করিয়া ভূতজগতে দৃষ্টিপাত কর – দেখিবে - জগতের আদর্শস্থানীয়া দিব্যনারীকুল একমাত্ৰ ভারতেই হিমাচলস্তরের ন্যায় অনুল্লঙ্ঘনীয় শ্রেণীতে তোমার কুললক্ষ্মীর সহায়তা করিতে দণ্ডায়মানা ! তাঁহাদের পদব্রজে কেবল ভারত নহে, কিন্তু সাব্ধিদ্বীপা সকাননা সমগ্ৰ পৃথিবীই সর্বকালের জন্য ধন্যা ও সগৌরবা হইয়াছেন । মূঢ় ! ভাব দেখি, ভারতের মৃত্তিকা - যাহাতে তোমার ও তোমার কুললক্ষ্মীর শরীরমন গঠিত হইয়াছে, ভারতের ধূলি - যাহা তোমার ও তাহার অঙ্গে আশৈশব লাগিয়া শরীর দৃঢ় করিয়াছে, তাহা সীতা, দ্ৰৌপদী, বুদ্ধৈকপ্ৰাণা যশোধরা, চৈতন্য-ঘরণী বিষ্ণুপ্রিয়া, ধর্মপ্ৰাণা অহল্যাবাই বা চিতোরের বীররমণীকুলের দেবারাধ্য পদম্পর্শে পবিত্ৰিত ! ভাব দেখি - ভারতের বায়ু - যাহা প্ৰতি নিশ্বাসে তোমাদের ভিতরে প্রবেশ করিয়া শরীর পুষ্ট করিতেছে, তাহা ঐ সকল দেবীদিগের পবিত্ৰ হৃদয়ে যুগে যুগে প্রবেশ লাভ ও ক্রীড়া করিয়া তাঁহাদের পবিত্রতায় ওতপ্রোতভাবে পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে ! - দেখিবে, তোমার, এ পাশ্চাত্য মোহ মরুমরীচিকার ন্যায় কোথায় সরিয়া গিয়াছে; আর উহা জলশূন্য বিজন মরুতে তোমাদের জলের প্রত্যাশায় ঘুরাইতে পরিবে না ! তোমার জগন্মাতা নারীকুলের উপর, বিশেষতঃ ভারতের রমণীকুলের উপর হৃদয়ের ভক্তি প্রেম উথলিত হইয়া তোমাকে আবার যথার্থ মনুষ্যত্বে প্ৰতিষ্ঠিত করিবে এবং তোমরা কুললক্ষ্মীকে সাক্ষাৎ দেবীপ্ৰতিমায় পরিণত করিবে ।

নারীর ভিতর জগৎপ্ৰসূতির বিশেষ বিকাশ প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিয়াই ভারতের দিব্যদর্শনসম্পন্ন ঋষিকুল মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন, নারী বুদ্ধিরূপা, শক্তিরূপা, জগজ্জননীর হ্লাদিনী, সৃজনী, ও পালনী শক্তির জীবন্ত প্ৰতিমাস্বরূপা । ঐ প্রত্যক্ষানুভব সৰ্বাঙ্গসম্পন্ন হইতে কিন্তু বহু সাধকের অনেককালব্যাপিনী সাধনার যে আবশ্যক হইয়াছিল, ইহা নিঃসন্দেহ । বৈদিক, ঔপনিষদিক ও দার্শনিক যুগের নারী-উপাসনার সহিত বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক যুগের ঐ বিষয়ের তুলনায় আলোচনা করিলে উহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় ।

বৈদিক ঔপনিষদিক যুগের নারী-উপাসনা ধীর, স্থির, শান্তভাবের । উহাতে উন্মত্ত প্রবাহের তাণ্ডবগতি নাই, অথবা ভীষণ আবর্তের প্রসারে উপাসকের চিত্তবিভ্ৰম উৎপন্ন করিয়া চিরকালের মত নিমগ্ন করিবার প্রভাব নাই। বৈদিক ঋষি পুরুষশরীরের ন্যায় নারীশরীরেও সমভাবে আত্মার বিকাশ অবলোকন করিয়া সর্ববিষয়ে পুরুষের সহিত নারীকে সমানাধিকার প্রদান করিয়া, তাঁহার পূজা ও সম্মান করিলেন । পরমাত্মার সাক্ষাৎ সন্দর্শনে এবং পবিত্ৰ স্পর্শে নারীও যে পুরুষের ন্যায় অতীন্দ্ৰিয় দিব্যদৃষ্টিসম্পন্না হইয়া ঋষিত্ব প্রাপ্ত হন, তাহা অবনতমস্তকে স্বীকার করিলেন । ঋক্‌ প্ৰভৃতি সংহিতা এবং উপনিষদের স্থানে স্থানে নারীঋষিকুলের উল্লেখ, জনকাদি রাজার সভায় ধর্মবিচারে গাৰ্গীপ্ৰমুখ নারীগণের পুরুষের সহিত সমভাবে যোগদানের উল্লেখ এবং অশ্বমেধাদি যজ্ঞক্রিয়ায় রাজার সহিত রাণীরও যোগদানের উল্লেখ থাকাই ঐ বিষয়ের যথেষ্ট প্রমাণ । এ তো গেল আধ্যাত্মিক জগতের কথা । ব্যবহারিক জগতেও নারীকুল পুরুষের সহিত যে বৈদিক যুগে সমসন্মান প্ৰাপ্ত হইতেন, তদ্বিষয়েরও বহু প্ৰমাণ পাওয়া যায় । তবে আমাদের কথায় কেহ যেন না ইহা বুঝিয়া বসেন যে, সংসারের কতকগুলি কার্যে যে নারীকুলেরই স্বভাবগত বিশেষাধিকার, এ কথা বৈদিক যুগে স্বীকৃত হইত না । উহা সর্বযুগেই ভারতে স্বীকৃত হইয়াছে এবং পরেও হইবে । তবে পাশ্চাত্য প্রদেশে খৃষ্ট জন্মিবার পাঁচ ছয় শতাব্দী পর পর্যন্তও যেমন নারীজাতিকে হেয়জ্ঞান করিয়া, তাহাদের ভিতর আত্মার অস্তিত্বই নাই, তাহারা পুরুষের ন্যায় কোনরূপ বিষয়সম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হইবার যোগ্যাই নহে, ইত্যাদি বিসদৃশ কথার স্বীকার এবং তদনুরূপ কার্যও সমাজের সর্ববিভাগে অনুষ্ঠিত হইত, বৈদিক যুগ হইতে কখন যে ভারতে এরূপ মত প্রচার ও কাৰ্যানুষ্ঠান হইয়াছিল, এবিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না ।

আবার বৈদিক যুগের বিবাহ প্ৰথায়, কুমারীকন্যার মাতৃত্বশক্তিবিকাশের অধিকারিণী হইবার প্রথম পরিচয়প্ৰাপ্তিমাত্ৰ “গৰ্ভং দেহি সিনীবালি” ইত্যাদি মন্ত্রে তাহার ‘মাতুমুখের’ পূজাদির বিধান থাকায় স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐকাল হইতেই ভারত নারীতে মাতৃপূজা করিয়া আসিতেছে । মাতৃমুখ বা স্ত্রীচিহ্নের বেদোক্ত ঐ পূজা যে দ্রাবিড়জাতির মধ্যগত স্ত্রীচিহ্নের পূজার বা তন্ত্রোল্লিখিত মাতৃমুখের পূজার ন্যায় ছিল না, ইহা বেশ বুঝিতে পারা যায় । উদ্দেশ্যের প্রভেদ দেখিয়াই ঐ কথা অনুমিত হয় । বৈদিকী পূজার উদ্দেশ্য কেবলমাত্ৰ মাতৃত্ব-শক্তির সম্মান; প্ৰাচীন দ্রাবিড়ি অনুষ্ঠানসকলের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র জায়ার ভিতর দিয়া প্ৰকাশিত নারীশক্তিরই পূজা; এবং তান্ত্ৰিকী পুজার লক্ষ্য, মাতা এবং জায়া উভয়ভাবে প্রকাশিতা নারীশক্তিরই মহিমা প্রচার ।

বেদে ঐরূপে নারীর মাতৃত্বশক্তির পূজাবিধান অল্পবিস্তর প্রাপ্ত হইলেও দ্রাবিড় জাতির ন্যায় স্ত্রী-পুংচিহ্নের উপাসনার কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না । পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, ঐ উপাসনা সুমের এবং তচ্ছাখা দ্রাবিড় জাতিরই নিজস্ব - বৈদিক আর্যদিগের নহে; নতুবা বেদেই উহার প্রমাণ পাওয়া যাইত । তিনি আরও বলিতেন, লিঙ্গাইত শৈবসম্প্রদায়, লিঙ্গোপাসনা বেদবিরুদ্ধ নহে এবং অথর্ববেদনিবদ্ধ যুপস্কম্ভের (স্তম্ভের) উপাসনাই লিঙ্গোপাসনা বলিয়া প্রচার করিয়াছেন । কিন্তু অনুধাবন করিয়া দেখিলে ঐ কথা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারা যায় না, কারণ যদি ঐরূপই হইবে, তবে বেদের অন্য কোন স্থলেই স্ত্রী-পুং-চিহ্নের পূজা-পরিচায়ক কোনও মন্ত্রবিধানাদি প্ৰমাণস্বরূপে পাওয়া যায় না কেন ? শিবলিঙ্গের পূজা যে পুং-চিহ্নের উপাসনা নহে, তাহার অন্য প্রমাণ উহার পূজাকালে পূজকের ‘ধ্যায়েন্নিতং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং’ ইত্যাদি মন্ত্রে ধ্যানধারণা করা । এজন্য বেদোক্ত বহুপ্রাচীন শিবপূজার এবং বৌদ্ধযুগের স্তূপসমূহের সহিত সংযোগ করিয়াই যে কালে বর্তমান লিঙ্গোপাসনা প্ৰবর্তিত হইয়াছে, ইহাই স্বামিজী যুক্তিযুক্ত মনে করিতেন ।

জায়ার ভিতর দিয়া প্ৰকাশিত নারীশক্তির দ্রাবিড়ি অনুকরণে পূজা বৌদ্ধযুগেই ভারতে প্ৰথম প্ৰবেশ লাভ করিয়াছিল; এবং কোনও নুতন ভাবের প্রথমোদয়ে লোকে যেমন উহাকেই সর্বেসৰ্বা ভাবিয়া সর্বত্র সকল কার্যেই উহার সংযোগ ও অনুষ্ঠান করিয়া থাকে, প্ৰায় সমগ্ৰ ভারত ব্যাপিয়া তদনুরূপ ভাবের অনুষ্ঠান হইয়াছিল । সেজন্যই দেখিতে পাওয়া যায়, বৌদ্ধযুগের তন্ত্ৰসকলের শিক্ষা - সকল রমণীর ভিতর কেবলমাত্র ঐ শক্তিরই সম্মাননা করা । সংযমী পুরুষসকলের ঐ শিক্ষায় কোনও ক্ষতি হইল না বটে - কিন্তু ঐ রূপ সংযমী পুরুষ কোনও জাতিবিশেষের ভিতর কয়টা দেখিতে পাওয়া যায় ? ইন্দ্ৰিয়াপরবশ অসংযমী ইতর-সাধারণ মানব ঐ শিক্ষা স্থূলভাবে গ্ৰহণ করিয়া বৌদ্ধযুগের শেষভাগে ভারতে যে কি অনাচার ব্যভিচারের স্রোত প্ৰবাহিত করিয়াছিল, তাহার আংশিক পরিচয় এখনও পুরী এবং দাক্ষিণাত্যের মন্দিরগাত্ৰস্থ বিপরীত পশুভাবসুচক মূর্তিগুলিতে দেখিতে পাওয়া যায় । ভারতের তন্ত্রকার সেজন্য অতি সাবধানে, অধিকারিভেদে রমণীর জায়াভাবের উপাসনার প্রবর্তনা করিয়া এবং বেদের অনুগামী হইয়া জনসাধারণে রমণীর মাতৃভাবের পূজারই বহুল প্রচার করিয়া বৌদ্ধযুগের ঐ দোষ পরিহার করিলেন । পঞ্চ 'ম'-কারসংযুক্ত তন্ত্রোক্ত বীরভাবের পূজা, যাহা সাধারণতঃ বামাচার বলিয়া কথিত হইয়া থাকে, তাহাতেই নারীর জায়াভাবের উপাসনা যে নিবদ্ধ রহিয়াছে, একথা আর বলিতে হইবে না । ঐ বীরভাবের প্রয়োগকুশল সিদ্ধগুরু এবং অনুষ্ঠানকুশল সংযমী শ্ৰদ্ধাবান্‌ সাধক - উভয়ই বিরল । উপযুক্ত গুরু লাভ করিয়া বিবাহিত ব্যক্তির ঐ ভাবের উপাসনায় উন্নতি লাভ হইতে পারে; কিন্তু যাহারা দারপরিগ্রহ করেন নাই, তাঁহাদের ঐ ভাবের উপাসনায় সহসা অগ্রসর হইলে পথভ্রষ্ট হইয়া পতন হইবারই বিশেষ সম্ভাবনা । সিদ্ধগুরু-সহায়ে সংযমী ব্যক্তিই কেবলমাত্র ঐ ভাবের উপাসনায় সিদ্ধকাম এবং উন্নত হইয়া থাকেন, একথা আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত ।

বামাচার” শব্দের অর্থ বুঝিলেই আমাদের পূর্বোক্ত কথা সহজে হৃদয়ঙ্গম হইবে । ‘বাম’ শব্দ এখানে ‘বিপরীত’ অর্থবাচক । অর্থাৎ পঞ্চ ‘ম’-কারাদি পদার্থ গ্রহণে ইতর-সাধারণে যে প্রকার উন্মত্তাবৎ অসংযত আচরণ করিয়া থাকে, তদ্বিপরীত আচরণযুক্ত হইয়া পূর্ণসংযমে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে সাধককে শিক্ষা দেওয়াই বামাচারের উদ্দেশ্য । অথবা ঐ সকল পদার্থের গ্ৰহণে ইতর-সাধারণ মানবের অধর্ম ভাবেরই উদ্দীপনা হইয়া থাকে; তদ্রূপ না হইয়া যাহাতে সুপ্তা কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হইয়া সাধককে অধিকতর সংযম, অধিকতর ধর্মভাব আনিয়া দেয়, তাহাই ঐ আচারের লক্ষ্য । আবার তন্ত্র বলেন, কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিত হইয়া মস্তকস্থ সহস্রারে উঠিবার সময় মূলাধার হইতে আরম্ভ করিয়া প্ৰতি চক্রকে বামাবর্তে পরিবেষ্টন এবং তচ্চক্রস্থ বর্ণসকলকে নিজাঙ্গে মিলিত করিয়া লয়েন এবং সমাধিভঙ্গের পর মস্তক হইতে পুনরায় মেরুচক্ৰে আসিবার সময় প্রতি চক্রকে বিপরীতভাবে অথবা দক্ষিণাবর্তে পরিবেষ্টন করিতে করিতে নিম্নে নামিয়া আসেন; কুণ্ডলিনী শক্তিকে ঐ রূপে জনসাধারণে অপরিচিত বামাবর্তে পরিভ্রমণ করাইয়া সহস্রারে উঠাইয়া সমাধিমগ্ন হইতে যে আচার শিক্ষা দেয়, তাহাই বামাচার - ঐ শব্দের উহাও, অন্যতম অর্থ । বামাচার শব্দের তন্ত্রোক্ত ঐ সকল অর্থের অনুধাবন করিলে বুঝিতে পারা যায়, উদাম উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্ৰয় দেওয়া, বামাচারের উদ্দেশ্য নয়; এবং কঠোরত্যাগী শ্ৰীগৌরাঙ্গ-প্রচারিত প্ৰেমধর্মকে যেমন বর্তমান কালের বাবাজী বৈরাগীদের ব্যভিচারের জন্য অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নহে, তেমনি ধৰ্মের নামে অনুষ্ঠিত বৌদ্ধযুগের এবং বর্তমান কালের ব্যভিচারসমূহের জন্য তন্ত্রোক্ত বামাচারকে দোষী নির্ধারণ করাও যুক্তিযুক্ত নহে ।

মানবপ্ৰেকৃতির স্বভাব পর্যালোচনা করিয়া আমরা বামাচারের সম্বন্ধে আর একটি কথাও সহজে বুঝিতে পারি । মানবকে যে বিষয়টির অনুষ্ঠান করিতে নিষেধ করা যায়, আমাদের মধ্যে এমন বিপরীতপ্রকৃতিবিশিষ্ট অনেক লোক আছে, যাহারা সেই বিষয়টিই অগ্ৰে করিয়া বসে । বামমার্গনিষিদ্ধ বস্তুসকলেরও ধৰ্মে একভাবে প্রয়োজনীয়তা আছে বলায়, ঐরূপ স্বভাববিশিষ্ট লোকসকলের ভিতরে পূর্বোক্ত প্ৰবৃত্তির উদয়ের পথ রুদ্ধ হইয়া যায় এবং ধর্মাচরণ করিতে আসিয়া তাহাদিগকে প্ৰবৃত্তির প্রেরণায় আর কপটাচায়ের আশ্ৰয় লইতে হয় না । বামমার্গের নিন্দাই সাধারণতঃ শুনিতে পাওয়া যায় । উহাতে যে কিছু ভাল আছে, একথা কাহাকেও বলিতে শুনা যায় না । আবার ঐ মার্গের সাধারণ গুরুরা অধিকারী নিৰ্বাচন না করিয়া সকলকেই ঐ পথের উপদেশ করিয়া সময়ে সময়ে অনেকের পতনের কারণ হইয়াছেন । তজ্জন্য আবার বামমাৰ্গকেই লোকে দোষী করিয়াছে । ঐ সকল কারণেই বামমার্গের পক্ষ সমর্থন করিয়া আমাদিগকে পূর্বোক্ত কয়েকটি কথা বলিতে হইল ।

ভারতের তন্ত্র ঐ রূপে নারীর মাতৃ ও জায়ারূপ উভয় ভাবের উপাসনার প্ৰবর্তনা করিয়া নারীপ্ৰতীকে বিশ্বজননীর উপাসনা সৰ্বাঙ্গ সম্পন্ন করিলেন, আর কুম্ভকার যেমন বাঁশ, বাখারি, খড়, মৃত্তিকাদিসহায়ে সুন্দর দেবমূর্তি গঠন করিয়া সাধকের পূজার সহায় হয়, ভারতের দার্শনিকগণ, বিশেষ আবার মহামুনি কপিল তদ্রূপ প্ৰকৃতিপুরুষবাদাদি নিজ নিজ মত প্রচারে তন্ত্রকারের সেই অসিমুণ্ড-বরাভয়করা, সৌম্যকঠোর, জীবনমৃত্যুরূপ সর্বপ্রকার বিপরীতভাবের সম্মিলনভূমিস্বরূপ মাতৃমূর্তির গঠনে সহায়তা করিলেন । তান্ত্রিক সাধক শ্রদ্ধা ও সংযম-সহায়ে ভক্তিপূরিতচিত্তে ঐ মূর্তির পূজা করিতে করিতে কালে সমাধিস্থ হইয়া দেখিলেন, বাস্তবিকই সে মূর্তি জীবন্ত, জাগ্ৰত, বিশ্বের সর্বত্র ওতপ্ৰোতভাবে পরিব্যাপ্ত । সমাধি-সহায়ে স্থূলবিশ্ব হইতে পৃথগ্‌ভাবে দূরে অবস্থিত হইয়া তিনি অনন্ত স্থূল ব্ৰহ্মাণ্ডের স্বরূপাকৃতি দেখিলেন - এক বিরাট শবশিবামূর্তি ! আর উহার মধ্যগত যত কিছু বিভিন্ন পদার্থ উহারা সকলেই সেই শবশিবার অঙ্গ-প্ৰত্যঙ্গ নখ-কেশ-লোমাদিরূপে নিত্য বিরাজমান । হৰ্ষ, বিস্ময়, ভয় প্ৰভৃতি অনন্ত ভাবে তাঁহার হৃদয় এককালে উদ্বেলিত হওয়ায় তাহার মুখ হইতে প্ৰথম বাক্য নিঃসৃত হইল -

করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুভুজাম্‌ ৷
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্‌ ৷৷
   * * *
এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং শ্মশানালয়বাসিনীম্‌ ৷

এইরূপে সমাধিমুখে বা ভাবমুখে প্ৰত্যক্ষ দর্শন করিয়াই যে সিদ্ধ সাধকেরা বিশ্বরূপিণী, বিশ্বজননীর বিবিধ রূপের ও বিবিধ ভাবের ধ্যান ও মন্ত্রাদি প্ৰাপ্ত হয়েন, এ বিষয় নিঃসন্দেহ ।

নারীর বিভূতি বা জায়াভাবের উপাসনা, পাশ্চাত্য বহু প্ৰাচীন কালে দ্রাবিড় জাতির নিকট হইতে প্ৰাপ্ত হইয়াছিল । তখন কারণপ্রিয়, ভূজগভূষিত উক্ষদেব (Bacchus) ও তচ্ছক্তি ঐশী (Isis) ইউরোপের নানাস্থানে নানাভাবে পূজা পাইতেন । বিরল সংযতমনা সাধকেরা শুদ্ধভাবে তাঁহাদের পূজা করিত । আর অসংযত উচ্ছৃঙ্খল ইতর-সাধারণ উহাদের পূজার নামে ব্যভিচারের প্ৰবল স্রোত পাশ্চাত্যের নানা স্থানে যে প্রবাহিত করিয়াছিল, ইতিহাস তাহা প্ৰমাণিত করে । উক্ষদেবের পূজায় নরনারীসকল গভীর নিশীথে গুপ্তচক্রে একত্র মিলিত হইয়া মদ্যপান এবং নানা অসংযতাচরণ যে করিত, প্ৰাচীন ইতিহাসে এ বিষয়েরও প্রমাণ পাওয়া যায় । তখনকার সম্ভ্রান্তবংশীয়া মহিলাদের ভিতরেও ঐরূপ পূজানুষ্ঠানের প্রচার ছিল । জগদ্বিজয়ী অসামান্য বীর আলেক্‌জাণ্ডারের মাতার ঐরূপ পূজানুষ্ঠানের কথা ইতিহাস-নিবদ্ধ । খৃষ্টধৰ্মের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত ঐ রূপ অনুষ্ঠানসকল যে অতি সাধারণ ছিল, ইতিহাস পাঠে ইহাও বুঝিতে পারা যায় ।

বৌদ্ধ ও ইরানী ধৰ্মের সারভাগ নিজাঙ্গে মিলিত করিয়া নবীন খৃষ্টধর্ম পূর্বোক্ত পূজার বিরোধী হইয়া দণ্ডায়মান হয় এবং কালে শার্লম্যান-প্রমুখ রাজন্যবৰ্গকে নিজ মতে দীক্ষিত করিয়া তাঁহাদের তরবারির সহায়েই নিজ প্রাধান্য স্থাপনে সমর্থ হয় । ছলে বলে কৌশলেই যে খৃষ্টধর্ম ইউরোপে প্ৰাচীন যুগে একাধিপত্য লাভ করে ইহা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ । সে যাহাই হউক, ঈশামাতা মেরীর পূজা প্ৰচলন করিয়া খৃষ্টধর্ম পাশ্চাত্যে প্ৰথম নারীর মাতৃভাবে পূজার কথঞ্চিৎ প্রচার করিয়াছিল । মাতৃপূজার ঐ বীজ কিন্তু ফলফুল-সমাচ্ছন্ন মহান মহীরুহে পরিণত হইয়া ভারতের ন্যায় পাশ্চাত্যকে প্রতি নারীর ভিতর ঐ ভাবের পূজা ও সম্মাননা করিতে শিখাইতে পারে নাই ।

ইউরোপের মাতৃপূজা ঐ মেরীমূর্তি পৰ্যন্ত যাইয়া আর অগ্রসর হইতে পারিল না । বহু প্ৰচীন উক্ষদেবের পূজাকাল হইতে নারীতে জায়াভাব বা শক্তিভাবের যে পূজা ও সম্মাননা করিতে ইউরোপ ক্ৰমে শিখিতেছিল, খৃষ্টধৰ্মের নবীন প্ৰবর্তনায় সে তাহা ছাড়িতে পারিল না । তবে কালে কথঞ্চিৎ শুদ্ধভাবে নারীর ঐ ভাবের পূজা করিতে শিখিল মাত্র ।

সমগ্ৰ পাশ্চাত্য যে ঐভাবে নারীজাতীর বিশেষ পূজা ও সম্মাননা করে, ইহা নিত্যপ্ৰত্যক্ষ । ইউরোপী পুরুষ নারীকে অগ্ৰে আসন, অগ্ৰে বসন, অগ্ৰে ভোজন দেয় । ট্রাম বা রেলগাড়ীতে স্থানাভাবে কোন রমণী দণ্ডায়মানা রহিয়াছেন দেখিলে, তৎক্ষণাৎ নিজে দাড়াইয়া আপন স্থানে তাঁহাকে বসিতে দেয় । যানারোহণের সময় রমণীদের অগ্ৰে উঠাইয়া পরে আপনি উঠে - ইত্যাদি নানা প্রকারে স্ত্রীজাতির সন্মাননা করিয়া থাকে । কিন্তু উপর উপর না দেখিয়া একটু তলাইয়া দেখিলেই উহা যে নারীর মাতৃভাবের পূজা নহে, শক্তিভাবের বা “গৃহলক্ষ্মী, ‘কুললক্ষ্মী’ ‘দেবী' ‘আনন্দময়ী’ প্রভৃতি শব্দনিহিত নারীর সংসারপালন, পুরুষ-নিয়ামক ঐশ্বর্যভাব - যে ভাব ঘনীভূত হইলে কালে মধুর বা জায়াভাবে পরিণত হয় - সেই ভাবেরই উপাসনা, তাহা সহজেই প্ৰতীয়মান হয় । কারণ, ইউরোপী পুরুষের ঐ পূজা ও সম্মান অপ্রাপ্তবয়স্ক কুমারী বা রূপযৌবনগলিত বৃদ্ধা নারী কদাচ পাইয়া থাকেন । সৰ্বাগ্রে যুবতী এবং পরে প্রৌঢ়া নারীগণই ঐ সন্মানের বিশেষ ভাবে অধিকারিণী । আবার রূপসৌন্দর্যভূষিত প্রৌঢ়ার সম্মুখে কুরূপ যুবতীও ঐ পূজায় নিম্নাসন পাইয়া থাকেন । আবার অপরিচিত পুরুষ অপরিচিত নারীকে সম্বোধন করিতে যাইয়া মাদাম (Madam) বা মিসিস (Mistress) প্রভৃতি যে সকল সম্মানসুচক শব্দ প্রয়োগ করেন, তাহাও যে নারীর শক্তিভাব বা ঐশ্বর্যভাবদ্যোতক তাহাও এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য । ইউরোপী পুরুষদিগের ঐরূপ আচরণ দেখিলেই আমাদের পূর্বোক্ত কথা হৃদয়ঙ্গম হইবে ।

ভারতের তন্ত্র শক্তিপূজায় নারীর মাতৃভাবের উপাসনার প্রাধান্যই যে প্ৰতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহা ভারতের পুরুষকুলের নারীজাতির প্রতি ব্যবহারেই স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় । এখানে বৃদ্ধা বর্ষীয়সী নারীই পুরুষের সম্মান অগ্ৰে পাইয়া থাকেন । রূপসৌন্দর্যভূষিত নারী স্বীয় স্বামীর জননীর অধীনে না থাকিলে নিন্দাভাগিনী হন । উদ্ধত বধূর পরামর্শে পুত্র যদি জননীকে কোনরূপে অবহেলা করেন বা তাঁহার মর্যাদা লঙ্ঘন করেন তো স্ত্রী-জিত অধর্মচারী বলিয়া নিন্দিত হইয়া থাকেন । অপরিচিতা রমণী প্রৌঢ়া হইলে ‘মা’, যুবতী হইলে কন্যাবাচী ‘বাছা’ বা ‘মা লক্ষী’ ইত্যাদি শব্দে অভিহিতা ও সম্মানিতা হয়েন । মাতাই সৰ্বাগ্রে পূজা পাইয়া থাকেন এবং মাতৃসম্বোধনে সম্বোধিত হইলেই রমণীকুল নিঃশঙ্কচিত্তে অপরিচিত পুরুষের সহিত বাক্যালাপ ও আবশ্যক হইলে তৎকৃত সেবা বা সাহায্যও গ্ৰহণ করিয়া থাকেন । অন্যান্য নানা বিষয়েও ঐরূপ আচরণ দেখিয়া নারীর মাতৃভাবের পূজা যে ভারতের কতদূর অস্থিমজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছে, তাহা বেশ অনুমিত হয় ।

জগৎকারণ ঈশ্বরকে ‘জগজ্জননী,’’ ‘জগদম্বা’ প্ৰভৃতি নামে অভিহিত করিয়া নারীভাবে উপাসনা করা ভারতেরই নিজস্ব সম্পত্তি । পাশ্চাত্য প্রভৃতি ভারতেতর দেশে ঈশ্বরের পিতৃভাবে উপাসনারই প্ৰচলন দেখা যায় । শুধু তাহাই নহে, খ্ৰীষ্টধর্মাবলম্বী বিশিষ্ট সাধকগণের অনেকে ঈশ্বরের নারীভাবারোপ করা মহাপাপের মধ্যে গণ্য করিয়া থাকেন । আবার নারীর শক্তিভাব বা ঐশ্বর্যভাবের বহুকাল হইতে উপাসনা করিয়া আসিলেও, ভারতের তন্ত্রোক্ত বামমার্গে যথাৰ্থ বীরসাধকগণের ন্যায় পাশ্চাত্যের কোন সাধকই ঐ ভাব ঈশ্বরে আরোপ করিয়া, তিনিই ‘আমার শক্তি’ - এই ভাবে তাঁহার উপাসনা করিতে সাহসী হন না । বহু প্ৰাচীন কালে ঐ ভাবের কিছু কিছু নিদর্শন ইউরোপী বিশিষ্ট সাধককুলের ভিতর পাওয়া যাইলেও, বর্তমানে উহার নামগন্ধও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । প্ৰাচীন যুগের ইউরোপীয় কোন কোন খৃষ্টান সাধিকার ঈশ্বরে বা ঈশ্বরাবতার ঈশায় পতিভাব আরোপ করিয়া সিদ্ধিলাভের কথা শাস্ত্রনিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায় । ঈশার ধ্যানে ও ভাবসমাধিতে তাঁহারা এমন তন্ময় হইতেন যে, ক্রুশারোহণকালে ঈশার যে যে অঙ্গ বিদ্ধ হইয়াছিল, তাহদের সেই সেই অঙ্গের সেই সেই স্থান হইতে শোণিত-নিৰ্গমনের কথাও লিপিবদ্ধ আছে । অপরদিকে আবার উপাস্য মেরীমূর্তির সহিত অঙ্গুরীয়-বিনিময় করিয়া তাঁহাকেই নিজশক্তি ভাবিয়া চিরকাল ব্ৰহ্মচর্য পালনের কথাও ইউরোপের প্রাচীন যুগের বিশিষ্ট সাধক-পণ্ডিত ইরাস্‌মসের জীবনচরিতে লিপিবদ্ধ আছে । ভারতের শক্তিপূজারই ভাবানুগত হইয়া যে ইউরোপের প্রাচীন যুগের ঐ সকল সাধকের ভিতর ঐরূপ ভাবসিদ্ধি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা ইতিহাসসহায়ে বেশ অনুমিত হয় । পরবর্তী যুগসকলে ভারতের সহিত ঐ সম্বন্ধ যত রহিত হইয়াছে, ততই ইউরোপ ঐ ঐ ভাবসহায়ে আধ্যাত্মিক জগতে অগ্রসর হইবার ও সিদ্ধিলাভ করিবার কথা ভুলিয়া গিয়াছে । তাহার উপর মার্টিন লুথার-প্ৰবর্তিত প্রটেস্ট্যাণ্ট ধর্ম, পূর্ণ ব্ৰহ্মচর্য ও সন্ন্যাসের বিরোধী হইয়া কেবলমাত্র নীতিসহায়ে মানবকে জীবন গঠন করিতে শিক্ষা দিয়া, ইউরোপের আধ্যাত্মিক জীবনের মূলে এককালে কুঠারাঘাত করিয়াছে । আবার, জড়বিজ্ঞানের প্রসারে ইউরোপের দৃষ্টি বর্তমানকালে কেবলমাত্র জড়েই নিবদ্ধ থাকায়, তাহাকে একেবারে ইহকাল-সর্বস্ব করিয়া তুলিয়াছে । কাজেই যে প্রকারেই হউক, সংসারের ভোগসুখ লাভই ইউরোপাদি পাশ্চাত্য দেশসমূহের এখন পরম পুরুষাৰ্থ বলিয়া বোধ হইতেছে । ইউরোপের আধ্যাত্মিক জীবনের এ গাঢ় অমানিশার কখনও অবসান হইবে কি না, তাহা ঈশ্বরই বলিতে পারেন । আশাভরসার মধ্যে কেবল ইহাই দেখা যায় যে, পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দের সহায়ে ভারতের ধর্মভাব বর্তমান যুগে পুনরায় আমেরিকা ও ইউরোপে কথঞ্চিৎ প্রবিষ্ট হইয়া ধীরে ধীরে পুষ্ট ও প্রসারিত হইতেছে ।

যুগাবতার ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যাবির্ভাবে নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজা ভারতে বর্তমান যুগে আবার বিশেষ সজীব হইয়া উঠিয়াছে । নারী প্রতীকে এমন শুদ্ধ ভাবের শক্তিপূজা জগৎ আর কখন দেখিয়াছে কি না সন্দেহ । জগন্মাতার ধ্যানসমাধিতে নিরন্তর তন্ময় হইয়া থাকা এবং তাঁহার প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করিয়া পঞ্চম বৰ্ষীয় শিশুর ন্যায় তাঁহার উপর সর্বদা সকল বিষয়ের জন্য সম্পূর্ণ, আত্মনির্ভর করা, সকল নারীর ভিতর জগদম্বার সাক্ষাৎ প্ৰকাশ উপলব্ধি করিয়া সকল সময়েই তাঁহাদের যথার্থ ভক্তিপূর্ণচিত্তে মাতৃসম্বোধন করিয়া তাঁহাদিগকে নিজ উপাস্য ইষ্টদেবতার মূর্তি বলিয়া জ্ঞান করা, বিবাহিত হইলেও প্ৰাপ্তযৌবনা পত্নীর সন্দর্শন মাত্ৰ মাতৃভাবের প্রেরণায় তাঁহাকে মূর্তিমতী সাক্ষাৎ জগদম্বারূপে দর্শন করিয়া মাতৃসম্বোধন করা এবং জবা বিল্বদল দিয়া তাঁহার শ্ৰীপাদপদ্ম পূজা করা, বেশ্যারমণীকুলের ভিতরেও জগন্মাতার দর্শনলাভ করিয়া তাঁহাদিগকে মাতৃসম্বোধনে সম্মানিত করিয়া সমাধিস্থ হওয়া, সর্বজনসমক্ষে ভক্তিপুতচিত্তে কুলাগারপ্রতীকে জগদ্‌যোনির পূজা করিয়া আনন্দে সমাধিমগ্ন হওয়া, তান্ত্রিকী পূজার উপকরণ ‘কারণ’ দেখিবামাত্র জগৎকারণের কথা মনে উদিত হইয়া প্ৰেমে ভক্তিতে বিহ্বল হইয়া পড়া এবং সর্বোপরি জগন্মাতার প্রেমে আত্মহারা হইয়া স্বার্থপর ভোগসুখ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া পূর্ণ ব্ৰহ্মচর্যে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকা - শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যময় জীবন ভিন্ন জগৎ আর কোথায়, কোন্‌ যুগে, কোন্‌ অবতারপুরুষের জীবনেই বা নারীপ্রতীকে শক্তিপূজার ঐরূপ জ্বলন্ত উচ্চাদর্শ দেখিয়াছে ? তাঁহার অলৌকিক জীবনালোকের সহায়েই, হে ভারত, তোমাকে এখন হইতে পবিত্ৰভাবে নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজার অনুষ্ঠান করিতে হইবে । হে ভারত-ভারতি, গুরূপদিষ্ট হইয়া পশু বা বীর যে ভাবাবলম্বনেই তোমরা নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজায় অগ্রসর হও না কেন, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পবিত্র জীবন সর্বদা সম্মুখে রাখিয়া তদনুষ্ঠান করিও এবং তাঁহার এই কথা হৃদয়ে স্থির ধারণা করিয়া রাখিও যে, ত্যাগ, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্যসহায়ে একাঙ্গী ভক্তিপ্ৰেমে সাধনায় প্ৰবৃত্ত না হইলে কোনও ভাবে পূজা করিয়াই জগন্মাতার দর্শন লাভ করিয়া কৃতাৰ্থ হইতে পরিবে না; জানিও ‘ভাবের ঘরে চুরি’ থাকিলেই ঐ পূজা বিপরীত ফল প্রসব করিবে !

হে বীর সাধক, তোমাকেই অধিকতর অবহিত থাকিতে হইবে । তোমাকেই ক্ষুরধারনিশিত দুৰ্গম পথ দিয়া অগ্রসর হইয়া নারীপ্রতীকে জগচ্ছক্তিরূপিণী জগদম্বার পূজা করতে হইবে । প্রবৃত্তির কুহকে ভুলিয়া তোমারই ধৈৰ্যচ্যুতি হইয়া পদস্খলিত হইবার অধিকতর সম্ভাবনা ! জানিও ভারতের তন্ত্রকার তোমার জন্য নিশিপূজার বিধান করিয়া তোমাকে দিবাপেক্ষা নিশিতেই অধিকতর অবহিত থাকিতে সঙ্কেত করিতেছেন - কারণ হিংস্ৰ শ্বাপদকুলের ন্যায় ভীষণ ইন্দ্ৰিয়গ্রাম নিশার তিমিরাবগুণ্ঠনেই নিঃশঙ্ক প্রচরণে সাহসী হইয়া উঠে । ভাবিও না, নিষ্কামভাবে নারীপূজা তোমার ভাবাশ্রয়ে হইবার নহে ! নিস্তেজ-ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাম বৃদ্ধ দম্পতির শরীরসম্বন্ধ উঠিয়া যাইয়া পরস্পরের প্রতি ঘনীভূত প্রেমসম্বন্ধে অবস্থিত হইবার কথা একবার স্মরণ কর । ভাবিয়া দেখ, পুরুষের নিকট রমণী তখন সখীভাবে পরিণতা; অথবা রমণীতে এবং জননীতে তখন আর বিশেষ প্ৰভেদ কোথায় ? কালধর্মে তাহারা তখন যে অবস্থায় উপনীত, অবহিত থাকিয়া সাধনাসহায়ে সৰ্বকাল নারীর সহিত তোমায় ঐ ভাবে অবস্থিত থাকিতে হইবে; তবেই তোমার ভাবসিদ্ধি উপস্থিত হইবে । বিপদ্‌সমূহ, কিন্তু তজ্জন্য তোমাকে তোমার গুরূপদিষ্ট মার্গত্যাগ করিতে বলিতে পারি না । যুগাবতার শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব কাহারও ভাব কখনও নষ্ট করেন নাই বা কাহাকেও তদ্রূপ করিতে শিক্ষা দেন নাই । অবহিত থাকিয়া, ত্যাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া, শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত শুদ্ধভাবে উপাসনায় রত থাকিলে তুমিও কালে জগদম্বার দর্শনইলাভে সিদ্ধকাম হইবে - গুরুভক্ত, শ্রদ্ধাবান্‌ সাধক, এই কথা তোমাকেও তিনি বার বার বলিয়া অভয় দিয়াছেন । অতএব জগদগুরুর শ্ৰীপাদুকার ধ্যান করিয়া, তাঁহার ঐ অভয়বাণী হৃদয়ে ধারণ কারিয়া, অবহিত হইয়া শক্তিপুজায় অগ্রসর হও-ধন্য হও ।

_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment