Thursday, April 20, 2017

শক্তিপ্রতীক - ২ (Power-worship : Shakti Symbol-2)


4.2) শক্তিপ্রতীক : দেব, মানব এবং অন্যান্য

(Power-symbols : God, Man & others)

সৰ্বকালে যে কোন বস্তু বা ব্যক্তি সাধককে গন্তব্যের নিকটবর্তী করিয়াছে বা ধর্মলাভের-নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব মানবাত্মা ও শ্রীভগবানের স্বরূপ জ্ঞানলাভের-সহায়ক হইয়া তদ্বিষয় উচ্চভাবসমূহ তাহার ভিতর উদ্দীপিত করিয়াছে, ভারত তাহাকেই প্ৰতীকরূপে অবলম্বন করিয়া উচ্চ হইতে উচ্চতর সত্যসোপানে আরোহণ করিয়াছে । সর্বদেশে সর্বজাতির ভিতরেই সত্যলাভের উহাই ক্ৰম । তবে, পৃথিবীর অন্য সকল জাতি নিম্ন সত্য হইতে উচ্চতর সত্যান্তরে উপনীত হইয়া প্রথমটিকে মিথ্যা বা ভ্ৰম বলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়াছে আর তাহার সহিত সম্পর্ক মাত্র রাখে না; শ্ৰদ্ধাসম্পন্ন ভারত তাহা না করিয়া অন্যরূপ করিয়াছে - কৃতজ্ঞতাপূর্ণহৃদয়ে ঐ নিম্ন সত্যকে যথাযথ স্থানে রাখিয়া - উচ্চাদর্শ গ্ৰহণে এবং তদ্বারা নিজ জীবন নিয়মিত করিতে এখনও অসমর্থ পুরুষসকলের কল্যাণের নিমিত্ত-চিরকাল উহার পোষণ ও পূজা করিায়াছে । ভারত উচ্চ উচ্চতর আদর্শসমূহ লাভে স্বয়ং কৃতাৰ্থ হইয়াই ভাবিয়াছে, এই “মই, বাঁশ, দড়ি বা সিঁড়ি অবলম্বনে আজ আমি সত্যসৌধের এই উচ্চ ছাদে আরোহণ করিলাম, কাল অন্য কেহও ত এই ছাদে উঠিবার সঙ্কল্প করিয়া আগমন করিতে পারে, তাহারও ত এই মই, বাঁশ, দড়ি বা সিঁড়ি অবলম্বন ভিন্ন গত্যন্তর নাই; অতএব তাহার বা তাহাদের সহায়তার জন্য উহা নষ্ট না করিয়া রাখিয়া দেওয়াই ভাল । ভারতের এই ভাবটিই শ্ৰীভগবান্‌ শ্ৰীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়া অমৃতময় গীতে এইরূপে চিরনিবদ্ধ করিয়াছেন :-
“ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্‌ ৷
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান যুক্তঃ সমাচরন্‌ ৷৷” - [গীতা]

জ্ঞানী সাধনফলে স্বয়ং ধর্ম বা ঈশ্বরজ্ঞানবিষয়ক উচ্চতম সত্যে আরোহণ করিয়াছেন বলিয়া দেশকালপাত্ৰভেদ বিচার না করিয়া, উহা জনসাধারণে প্রচার করিবেন না । কিন্তু অজ্ঞ ব্যক্তি দৃঢ়বিশ্বাসসহকারে শ্ৰীভগবানের উপাসনার নিমিত্ত যে যে কৰ্মের অনুষ্ঠানে রত, তৎসকলের অনুমোদন ও যথাসম্ভব আচরণ করিয়া, তাহার শ্রদ্ধা যাহাতে ঐ বিষয়ে আরও দৃঢ়ীভূত হয়, তাহাই করিবেন । কারণ, ধর্মগত উচ্চতম সত্যের ধারণা ব্যক্তিগত সাধনের পরিপক্কাবস্থায় আপনা আপনি উদয় হইয়া থাকে । কেবলমাত্ৰ কাহারও কথায় তল্লাভ কাহারও কথন হইবে না ।

ঐ ভাবটি লক্ষ্য করিয়াই শ্রীরামকৃষ্ণদেব আবার বর্তমান যুগে আমাদের শিক্ষণ দিয়াছেন — “কাহারও ভাব নষ্ট করতে নাই; ভাব নষ্ট করা মহা দোষ । যেমন ভাব - তেমন লাভ । ভাব আশ্রয় করিয়াই মানুষ সত্যবস্তু লাভ করে; কারণ, শ্ৰীভগবান স্বয়ং ভাবময় ! সোলার আতা বা হাতী দেখিলে যেমন সত্যের আতা ও হাতী মনে পড়ে, সেইরূপ মৃন্ময়ী, পাষাণময়ী মূর্তি দেখিলে চিন্ময়ী মূর্তির উদ্দীপনা হয়,” ইত্যাদি ।

শক্তিপূজার অবতারণায় আমরা প্ৰথমেই গুরূপাসনার উল্লেখ করিয়াছি । কেন না, গুরুপ্রতীকই সর্বপ্ৰতীকশ্রেষ্ঠ বলিয়া জনসমাজে পরিচিত হইয়া বর্তমান যুগে সৰ্বাগ্ৰে পূজিত হইয়া থাকে । হইবারই কথা - কারণ, শ্ৰীগুরুই ইষ্টমন্দিরের দ্বারস্বরূপ । দ্বাররুদ্ধ থাকিলে যেমন মন্দিরে প্রবেশ লাভ হয় না, শ্রীভগবানের গুরুশক্তি প্ৰসন্ন না হইলে, সেইরূপ মানবের ইষ্টদর্শনাশা বৃথা । মায়ানিরুদ্ধদৃষ্টি ভ্ৰান্ত মানবের চক্ষুরুন্মীলন করিবার জন্যই কৃপাপরবশ শ্রীভগবানের গুরুরূপে উদয় । সৰ্বদেশে সর্বকালে মানব যাহা কিছু সত্য বা জ্ঞান লাভ করিয়াছে বা করিবে, তাহা ঐ গুরুশক্তিপ্ৰভাবে । বাহ্যান্তরভেদে নানা প্ৰতীক অবলম্বনে গুরুশক্তিই প্ৰকাশিত হইয়া তাহাকে ধীরনিশ্চিত গতিতে দেশকালাবচ্ছিন্ন জগতে নিম্ন সত্য হইতে উচ্চতর এবং উচ্চতম সত্যে আরূঢ় করাইতেছে । আবার ঐ গুরুশক্তিই পূর্ণ স্বরূপে, সাত্ত্বিকবিগ্ৰহে মানবশরীর ও মানবীয় ভাবাবলম্বনে যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া, নিত্য নূতন নূতন ধর্মাদর্শ নিজ জীবনে প্রতিফলিত করিয়া, মানবকে সেই ছাঁচে জীবন গঠিত করিতে শিক্ষা দিয়া, দেশকালাতীত, কেবলানন্দরূপ সমাধিতে তুরীয় সত্যানুভবের উপায় সহজ ও সুখবোধ্য করিয়া দিতেছে ! সেইজন্যই উপনিষদে আপ্তকাম ঋষি গাহিয়াছেন, -
“যস্য দেবে পর ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ ৷
তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ৷৷” - [শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ]
“ইষ্টদেবের ন্যায় গুরুতে যাহার পরম ভক্তিশ্রদ্ধা, তাহারই নিকট পরম সত্য আপন স্বরূপ প্ৰকাশ করেন ।” সেই জন্যই কথিত আছে — “শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্ৰাতা, গুরৌ রুষ্টে ন কশ্চন ৷” - [গুরুগীতা]

দেবদেব উপেক্ষিত হইলে গুরুশক্তিসহায়ে মানব তাঁহার প্রসন্নতা পুনরায় লাভ করিতে পারে, কিন্তু দয়াঘনমূর্তি শ্ৰীগুরুশক্তি কোনও কারণে অপ্ৰসন্না হইলে, মানবের জ্ঞানলাভের দ্বার বহুকালের জন্য রুদ্ধ হইয়া গাঢ় অন্ধতম আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ফেলে - সে তমোগুণের হস্ত হইতে নিস্তার লাভ এক জীবনে কখনই সম্ভবপর হয় না । সেই জন্যই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার ইংরাজিভাবাপন্ন শ্রদ্ধানভিজ্ঞ বালশিষ্যমণ্ডলীকে নিজ শরীর দেখাইয়া বলিতেন - “দ্যাখ, এটা কেবল খোলমাত্র; এই খোলটাকে আশ্ৰয় করে শুদ্ধবোধানন্দময়ী মা লোকশিক্ষা দিচ্চেন; সেজন্য এর কাছে এলে, একে স্পর্শ কর্‌লে, এর সেবা কর্‌লে লোকের ধর্মভাবের উদ্দীপনা হয়ে ঈশ্বরলাভ হয়; কিন্তু খুব সাবধানে শ্রদ্ধার সহিত এটার সেবা কর্‌বি । শ্রদ্ধার অভাবে আমি রাগ করব না; কিন্তু এর ভিতর যে আছে, সে যদি অবজ্ঞাত হয়ে একবার ছুবলে দেয়, তা হলে জ্বালায় অস্থির হতে হবে ।” এক সময়ে কোন দুরন্তু শিষ্য নিজ ঘৃণিত জীবনালোচনায় ক্ষুব্ধ হইয়া দুঃখে অভিমানে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নানা অযথাভাষণ করে । অপার দয়ানিধি শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাহাতে তাহার জন্য বিশেষ চিন্তান্বিত হইয়া ব্যাকুলভাবে বলিয়াছিলেন, - “ওরে, ও আমাকে যা বলে, বলুক গে; (নিজ শরীর দেখাইয়া) এর ভিতরে যে আছে, তাকে ত কিছু বলে নি ? আমার চিদানন্দময়ী মাকে ত কিছু বলে নি ?”

হে ভারত, সাবধান ! গুরুশক্তিবলে বলীয়ান্‌ ! বিদেশী ভাবাপন্ন হইয়া আজ বিদেশী অনুকরণে শ্ৰীগুরুর পূজায় অবহেলা করিও না; আজি আট শত বৎসরের অধিক কাল হইল, নানারূপে নানাভাবে বিদেশী আসিয়া, কখন স্তুতিবাদ করিয়া, আবার কখন বা ভয় দেখাইয়া তোমাকে ঐ শক্তিপূজায় বিরত হইতে পরামর্শ দিতেছে - পাশব-বল প্রয়োগে বিধ্বস্ত করিয়া, দুঃখদারিদ্র্যনিপীড়িত তোমার পরিম্লান চক্ষের সমক্ষে নানা প্ৰলোভন আনিয়া একে একে ধরিতেছে । কিন্তু শ্ৰীগুরুশক্তিরই পরিণামে জয় ভাবিয়া, তুমিও এতদিন তাহা উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছ । সেজন্য বাবিল, মিসর, রোম, গ্রীস ও তুর্কাদি জাতিসমূহ দুৰ্জয় কালস্রোতে তৃণগুচ্ছের ন্যায় কোথায় ভাসিয়া যাইলেও, কৌপীনমাত্ৰাচ্ছাদিতকটি, তিতিক্ষাসম্বল, অনিত্যের ভিতর সর্বদা নিত্যদর্শনাভিলাষী, গুরুপাদনিবদ্ধদৃষ্টি ও তদনন্যশরণ তোমার সন্তানকুল সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া আজও বর্তমান ! তোমারই পুণ্যক্ষেত্রে আজও সর্বদেবদেবীস্বরূপ দিব্য গুরুশক্তি মানুষী তনু পরিগ্ৰহ করিয়া নিজমহিমা প্ৰকাশ করিয়া “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং” আবিভূর্তা হইতেছেন । তোমারই সন্তানকুলের সমষ্টিভূতমূর্তিস্বরূপ নরাবতার অর্জুন, কুরুক্ষেত্র-সমরের প্রথমাঙ্কে শ্ৰীগুরুপাদুকোদ্দেশে সর্বতোভাবে আত্মোৎসর্গ করিয়া কাতরকণ্ঠে যাহা বলিয়াছেন, -
“কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ, পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ ৷
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্ৰূহি তন্মে, শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্ৰপন্নম্‌ ৷৷” - [গীতা]
“হে প্ৰভু ! ভয়, মমতা প্ৰভৃতি নানা দুর্বলতায় আচ্ছন্ন হইয়া আমি, কি যে করা কর্তব্য, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না । আমার অহঙ্কার অভিমান দূর হইয়াছে - আমি এখন দয়ার পাত্ৰ । এ সময় যাহা করা কর্তব্য, যাহা করিলে আমার ও অন্যের মঙ্গল হয় এবং অধর্মাচরণ করা না হয় তাহাই আমায় বলিয়া দাও । আমি তোমার শরণাগত শিষ্য - আমাকে আশ্ৰয় দাও, পথ দেখাও ।”
- তাহা তোমার প্রত্যেক এবং সকল সন্তানের জন্যই উচ্চারিত হইয়াছিল । সে হৃদয়ের প্রার্থনা শ্ৰীগুরু-চরণপ্ৰান্ত সকলের জন্য সৰ্বকালের নিমিত্ত পৌঁছিয়াছে ! সে অভয়বাণী - “অহং ত্বাং সৰ্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ” - তোমার সন্তানের প্ৰত্যেককে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে দৈব-বলে বলীয়ান্‌ করিয়া রাখিয়াছে ! ধৈর্য ধর, পবিত্ৰভাবে নিৰ্ভীকহৃদয়ে তাঁহারই অনন্যশরণ হইয়া থাক - তোমাকে অবলম্বন করিয়া শ্ৰীগুরুর এখনও অনেক লীলা প্ৰকটিত হইবে ! দেখিতেছি না কি - অন্তর্জগতে, ধর্মজগতে তোমার সন্তান এখনও রাজা ? ইতিহাস-সহায়ে দেখ - সৰ্বকালে বৈদেশিক নিৰ্যাতন তোমার সন্তানের মাংসপিণ্ডময় ক্ষণভঙ্গুর শরীরটাকেই কয়েক দিনের জন্য মাত্ৰ নানাপ্রকারে ক্লিষ্ট করিতে পারিয়াছে - তাহার অমরাত্মাকে কে বাঁধিবে ? কে কখন তাহার অপ্ৰতিহত গতি রোধ করিয়াছে ? সত্যকে ধরিয়া, ন্যায়কে ধরিয়া ধৰ্মে সদা প্রতিষ্ঠিত থাক, জানিও -ভাব- জগৎই স্থূল জগৎটাকে ইচ্ছামত ভাঙ্গিতেছে, গড়িতেছে, পরিবর্তিত ও নিয়মিত করিতেছে; জানিও - কোন শৰ্বরীই চিরস্থায়ী নয় সকল অবস্থারই পরিবর্তন ধ্রুব । অহেতুকদয়াসিন্ধু শ্ৰীগুরুর পূজা প্রচলিত হইবার পূর্বেই কিন্তু ভারতে নানা প্ৰতীকের অভ্যুদয় হইয়াছিল । তত্তদ্বিষয়ের কিঞ্চিৎ আলোচনা না করিয়া, আমরা পুনরায় শক্তিপূজার সহায়ক অন্যান্য প্রতীকের কথা পাঠকের সম্মুখে আনয়ন করিব না ।

শ্ৰদ্ধাবাতাহতা, প্ৰেমবিকম্পভঙ্গিতা, বিজ্ঞানগুহাশায়িনী, প্ৰণবনাদিনী, চিরপাবনকরী, ভাবময়ী ধর্ম-গঙ্গার উৎপত্তিস্থান নিৰ্ণয় করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের অনেক মানবের অন্তঃস্থিত ভীতি-শৈলের শিখরদেশ নির্দেশ করিয়াছেন । আবার কেহ বা বলিয়াছেন – সৃষ্টিকল্পের প্রারম্ভে আদিম মানব বিচিত্র শক্তিশালী নানা পদার্থের সমষ্টিভূত – বিশ্ববিরাট্‌ দর্শনে বিস্ময়রসে আপ্লুত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন শক্তি প্ৰকাশের অবলম্বনসমূহের পশ্চাতে ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর কল্পনা করিয়া হৃদয়ের পূজা অৰ্পণ করিয়াছিল; ঐ বিস্ময়-ভূধরের পাদমূলেই সনাতনী ধর্ম-ভাগীরথীর আদিম বিকাশ ! - উহাই প্রতীকোপাসনার বাস্তব মূল । ভারতের বেদগান ঐরূপেই প্ৰথমে সমুত্থিত হইয়া, জলদগম্ভীর সামধ্বনি ও পূতগন্ধী বিশ্বদেববলিধূমে সান্ধ্যগগন পূর্ণ করিয়াছিল ।

আমাদের ধারণা কিন্তু অন্যরূপ । চিজ্জড়সম্মিলনী, বিপরীতগুণধারিণী, বাহ্যান্তরপ্ৰতিঘাতিনী, উভয়মুখী মানবপ্রকৃতি সৰ্বকালেই এক বিষম জটিল রহস্য । সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের নানা ঘাতপ্ৰতিঘাত এবং ভূয়োদৰ্শন-সহায়েই তাহাতে নিত্য জীবেশ্বরসম্বন্ধ, পরলোকাস্তিত্ব, আত্মার চিন্ময়ত্ব ও অমরত্ব, সৃষ্টিপ্রবাহের অনাদিত্ব এবং দেববিগ্ৰহাদির বর্তমানত্বাদি-মূলক বিশ্বাসনিচয় একত্রীভূত হইয়া বর্তমান ধর্মবিশ্বাসরূপে প্ৰকাশিত হইয়াছে । জটিল মানবপ্ৰেকৃতির জটিল ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি জটিলভাবেই সাধিত হইয়াছিল । তুঙ্গশৃঙ্গ গিরিরাজি, সর্বগ্রাসকর জলধি, বিকটোল্লাস অশনি, নিশি-দিবাকর সূর্য, রাগরঞ্জিত উষা প্ৰভৃতি বাহিরের ভীষণ ও সুন্দর পদার্থনিচয়, যেমন জাগ্ৰদবস্থায় আদিম মানবের মনে ভীতিবিস্ময়াদি ভাবসমূহের উদয় করিয়া বাহ্য প্রতীকাবলম্বনে নানা দেবদেবীর পূজা করিতে তাহাকে শিখাইয়াছিল, সেইরূপ মোহময়ী নিদ্রারাজ্যে নিত্য প্রবিষ্ট হইয়া সে অঘটনঘটনপটীয়ান্‌ স্বপ্নের কুহকে যে সমস্ত অদৃষ্টপূর্ব দেশ, কাল, পাত্ৰাদির অনুভব করিত, ঐ সকলকে জাগ্ৰদনুভূত পদাৰ্থসকলের ন্যায় বাস্তব বলিয়া বিবেচনা করিয়া সে ইহলোক-ভিন্ন অপর এক লোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতে শিখিল । বাহ্যান্তরভেদে এইরূপে দুই প্রকার অনুভবের সহায়ে তাহার দুই প্ৰকার শিক্ষা যুগপৎ চলিয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ।

কালে সর্বরহস্যের উচ্চতম রহস্য মৃত্যুর সহিতও তাহার পরিচয় হইতে লাগিল এবং ক্রমে তাহার হৃদয়ঙ্গম হইল — মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যু সকলকেই একদিন গ্ৰাস করিবে । অধীর হৃদয়ে সে ভাবিতে লাগিল - এ কি ? এ আবার কোন দেবতা ? এইরূপে নচিকেতারূপী মানব মৃত্যুমুখেই ক্রমশঃ শিখিল - ইহকালেই তাহার অস্তিত্ব পর্যবসিত নহে - পরকাল আছে — এবং পরকালেও তাহার অস্তিত্ব সুনিশ্চয় । প্ৰেতাত্মাসকলের স্বপ্নে ও কখন কখন জাগ্ৰতে সন্দর্শনে তাহার ঐ পরকাল-বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হইল । জগতের সকল জাতির প্রাচীন পুরাণসংগ্রহে উক্ত প্রেতাত্মাকুলের দর্শনের কথা লিপিবদ্ধ আছে এবং এখনও ঐরূপে প্ৰেতাত্মাকুলের দর্শন যে সম্ভবপর, এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবার বহুলোক, কি প্রাচ্য, কি পাশ্চাত্য সকল ভূখণ্ডেই বিদ্যমান । ঐরূপ দৰ্শন হইতেই যে প্রাচীন যুগে পিতৃপুরুষের পূজা প্রচলিত হয়, এ বিষয় নিঃসন্দেহ । প্রাচীন মিসরে ঐ সকল প্ৰেতাত্মা ‘কা’ নামে নির্দিষ্ট হইত । ঐ ‘কা’ সকল, তাহাদের জীবিত সন্তানাদির নিকট আবির্ভূত হইয়া, স্ব স্ব দুঃখকষ্টের কথা জানাইত। “আমাদের অন্ন দে, বস্ত্ৰ দে, অন্য সব ভোগ্য পদার্থ দে” - ইত্যাদি বলিত; “না দিলে তোদের ধবংস করিব ।”-বলিয়া ভয় দেখাইত - এ সকল কথা তাহদের ভিতর লিপিবদ্ধ আছে । ভারতের পিতৃশ্ৰাদ্ধাদি, চীন ও জাপানের সিণ্টো-উপাসনা, ইউরোপ এবং আমেরিকার পূর্বের কথা ছাড়িয়া দিলেও বর্তমান যুগের ভূতুড়ে চক্রানুষ্ঠান (Spiritualism and Seance) প্রভৃতি ঐ বিষয়ের যথেষ্ট সাক্ষ্য ।

এইরূপে যত দিন না আদিম মানবের মনে পরকালবিশ্বাস সমুদ্ভূত হইয়াছিল, ততদিন যে সে ধর্মবিশ্বাসে ধনী হইয়াছিল, একথা বলা যায় না । আবার পরকালবিশ্বাস এবং বিভিন্ন শক্তির আধার নানা দেবদেবীতে বিশ্বাস যে তাহার মনে যুগপৎ উদয় হইয়াছিল -- একথাই যুক্তিসিদ্ধ বলিয়া বোধ হয় । প্ৰথমে ঐ সকল দেবদেবীর আবাস হিমালয়, সিনাই প্রভৃতি অত্যুচ্চ ভূধরশৃঙ্গে নির্ধারিত হয় । পরে মানব যখন সাহসাবলম্বনে ঐ সকল গিরিচুড়ার মস্তকে উঠিয়া তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াও ঐ সকল দেবদেবীর পরিচায়ক চিহ্নমাত্রেরও দর্শন পাইল না, তখন স্থির হইল, তাঁহারা কখন কখন ঐ সকল ভূস্বৰ্গে আগমন করেন মাত্ৰ - নতুবা তাঁহাদের চিরাবাসস্থল নানানক্ষত্ৰবিরাজিত ঐ সুনীল গগনের উপর ‘দ্যৌঃপিতরে’র অবস্থানভূমিতে, কৈলাসে, গোলোকে, কিন্নর-কিন্নরীশোভিত স্বৰ্গে, ইত্যাদি । আবার উচ্চাবচ পুণ্যপাপময় কৰ্মের কথা আলোচনায় উক্ত পরলোকবিশ্বাসও ক্রমে পিতৃলোক, দেবলোক, অন্ধতমোবিশিষ্ট লোক, নরক এবং তিৰ্যগ্‌যোনি প্ৰভৃতিতে মৃতব্যক্তিসকলের স্থান নির্ধারিত করিল ।

এইবার পৃথিবীতে বহুকাল বাস ও বহুদর্শনের ফলে মানবজাতির মধ্যে ভূতবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অঙ্কুরসমূহ ধীরে ধীরে উদ্‌গত হইতে লাগিল এবং ঐ সকল ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর শক্তি এক মহাশক্তিমানের লীলা বলিয়া অনুমিত হইয়া তাহাকে কালে এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী করিয়া তুলিল । স্তম্ভিতহৃদয়ে মানব ভাবিল – যিনি সকলের নিয়ন্তা, -
“যস্য ব্ৰহ্ম চ ক্ষত্ৰঞ্চ উভে ভবত ওদনম্‌ ৷
মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্ৰ সঃ ৷৷” - [কঠোপনিষৎ]
“যাহারা ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় উভয়েই খাদ্যরূপে পরিগণিত, স্বয়ং মৃত্যু যাঁহার ঐ খাদ্যের উপযোগী ব্যঞ্জনসদৃশ, সেই কালান্তক বিশ্বদেবকে কে জানিতে সক্ষম ?”

কিন্তু এই খানেই শেষ হইল না ! এইবার ঔপনিষদিক যুগের প্রারম্ভ হইল । মানব ধ্যানাদি-সহায়ে জানিতে ছুটিল - সেই ঈশ্বর সৃষ্টির বাহিরে বা অন্তরে । প্ৰথমে স্থির হইল - তিনি সৃষ্টির বাহিরে - সৃষ্ট বিশ্ব হইতে অত্যন্ত বিভিন্নগুণবিশিষ্ট; জীব সেবক, তিনি সেব্য; জীব তাঁহাকে কখন ধরিতে ছুঁইতে পরিবে না ।

পরে স্থির হইল - তিনি সৃষ্টির অন্তরে ও বাহিরে - বিশ্ব তাঁহার একাংশে বর্তমান - “একাংশেন স্থিতো জগৎ"; জীব অংশ, তিনি পূৰ্ণ; দেহের সহিত ভিন্ন ভিন্ন অবয়বাদির সম্বন্ধের ন্যায় উভয়ে অবস্থিত । শেষে স্থির হইল - সসীম মন বুদ্ধির ভিতর দিয়া তাঁহাকে দেখিলেই তিনি বিশ্বরূপে আপাতপ্ৰতীত হন মাত্ৰ ! কোনক্রমে মনবুদ্ধিরূপ গণ্ডির বাহিরে যাইতে পারিলে তবে শুদ্ধ সত্যানুভব সাধ্য; সেখানে “একমেবাদ্বিতীয়ম্‌” - দুই তা নাইই, এক যে আছে, একথাও বলা যায় না; তিনি পূর্ণ, নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব । আর জীব ? - জীব বলিয়া কোন পদার্থ এখানে থাকিলেও সেখানে নাই ! - সাধকাগ্ৰণী শ্ৰীরামপ্রসাদ যেমন বলিয়াছিলেন –
“বেদের আভাস তুই ঘটাকাশ, ঘটের নাশকে মরণ বলে ।
ওরে শূন্যেতে পাপ পুণ্য গণ্য, মান্য করে সব খোয়ালে ।।
প্রসাদ বলে, যা ছিলি ভাই, তাই হবি তুই নিদানকালে ।
যেমন জলের বিম্ব জলে উদয়, জল হয়ে সে মিশায় জলে ।।”
তবে পাপপুণ্য, ধর্মাধর্ম, কর্মাকৰ্মের কারণ কি ? - যতক্ষণ শরীর, মন, বুদ্ধির গণ্ডির ভিতর, ততক্ষণ ওসকল সত্য; যেমন যতক্ষণ স্বপ্ন দেখা যায়, ততক্ষণ স্বপ্ন সত্য বলিয়া প্ৰতীত ।

তবে এ সংসার-স্বপ্ন মৃত্যু হইলেই কি ভাঙ্গিয়া যায় ? না - কোটি জন্মেও, বিজ্ঞানের উদয় না হইলে ভাঙ্গে না । আবার তীব্ৰ ইচ্ছাসহায়ে এক জন্মেই উহা ভাঙ্গিয়া দেওয়া যাইতে পারে।

এইরূপে সম্পূর্ণ ধর্মচক্ৰ ভারতে প্ৰবর্তিত হইল । বাকি রহিল মাত্ৰ - তৰ্কযুক্তিসহায়ে উহাকে মানব-মনের যথাসম্ভব বোধগম্য করা এবং সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ যাহাতে ঐ সত্যের দিকে অগ্রসর হইতে পারে, সেই ভাবে সমাজ গঠন । ভারতের কপিলাদি দার্শনিকগণ এবং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ হইতে আরম্ভ করিয়া বুদ্ধ, শঙ্করাদি অবতারনামা যত মহাপুরুষ অদ্যাবধি ভারতে শরীর পরিগ্ৰহ করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ঐ বিশয়ে সহায়তা করিয়াছেন ও করিতেছেন । সে অনেক কথা - কিন্তু ইহা তাহার স্থান নহে ।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের ধর্মসম্বন্ধীয় গবেষণা পাঠ করিলে উহাতে বিশেষ অঙ্গহানি লক্ষ্য হইয়া থাকে । হইবারই কথা । কারণ, পাশ্চাত্যপ্ৰদেশ এতকালেও কর্মী ভিন্ন একজনও বিশিষ্ট ধর্মবিজ্ঞানীর জন্মদানে সক্ষম হইল না । প্ৰাচ্যভূমি আসিয়া, বিশেষতঃ ভারত হইতেই ধর্মালোক যে পাশ্চাত্যে পূর্ব পূর্ব অতীত যুগে বরাবর সঞ্চারিত হয়, এ বিষয়ের সত্যতা, পৃথিবীর প্রাচীনেতিহাস যতই অলোচিত হইবে, ততই প্ৰমাণিত হইবে - ততই মানব বুঝিতে পারিবে, হিন্দুর নিত্য-পূজ্য বেদ হইতেই ধর্মালোক পৃথিবীর সর্বত্র বিকীর্ণ হইয়াছে । খৃষ্ট জন্মিবার সহস্ৰ বৎসরেরও অধিক কাল পূর্বে যখন গ্ৰীকজাতি বিশেষ বলদৃপ্ত হইয়া অন্যান্য সকল জাতিকে পাশব-বলে আপনি অধীনে আনিতে ব্যস্ত, তখন হইতে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার আদিগুরু গ্রীসের সহিত ভারতের সম্বন্ধবিস্তারের কথা ইতিহাস স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছে । তাহার পূর্বে যে সম্বন্ধ ছিল না একথাও স্পষ্ট বলা যায় না । ভারতের ধর্মপ্রচারক এবং কোন কোন স্থলে ভারতের বণিককুলও যে, ঐ কাল হইতে গ্রীস এবং তৎসন্তান রোম সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল, এ বিষয়েও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে । পালিস্তানের আন্টিয়ক্‌ শহরে ভারত-সম্রাট্‌ ধর্মাশোকের ধর্মশাসনক্ষোদিত প্ৰস্তরস্তম্ভ ঐ বিষয়ের জ্বলন্ত নিদর্শনস্বরূপ এখনও দণ্ডায়মান । ইউরোপের উল্লেখযোগ্য প্ৰথম দার্শনিক ‘পিতাগোরসে’র-নাম এবং সংখ্যা হইতে জগদ্যুৎপত্তিরূপ দার্শনিক মতে ভারতের পুতগন্ধের বিশেষ অনুভূতি হয় । কে না জানে — ভারতের সাধু ও আচার্যকুল অদ্যাবধি “পিতা, গুরু’ শব্দাদিতে জনসাধারণ কর্তৃক অভিহিত হন ? কে না জানে - শ্ৰীভগবদবতার মহামুনি কপিল চতুৰ্বিংশতি তত্ত্ব হইতে জগদ্যুৎপত্তি নির্ণয় করিয়া, আপন মীমাংসা ‘সাংখ্য” নামে জনসাধারণে প্রচারিত করেন ? সংখ্যা হইতেই যে উক্ত সমাধান ‘সাংখ্য’ শব্দে অভিহিত - একথা আর কাহাকেও বলিয়া দিতে হইবে না । এইরূপে গ্ৰীসরোমের ভিতর দিয়া যে ভারতের ধর্মমতসমূহই পূর্ব পূর্ব কালে প্রচারিত হইয়াছিল - এ বিষয়ের প্ৰমাণসংগ্ৰহ দিন দিন বৃদ্ধি হইতেছে ।

প্ৰাচীন ইউরোপে ধর্মালোক-বিস্তারের আর এক কেন্দ্র ছিল মিসর । ঐ মিসরও যে ভারতের ধর্মালোকে দীপ্ত হইয়াছিল - এ বিষয়েও অনেক প্ৰমাণ পাওয়া যাইতেছে । প্ৰাচীন মিসরি মিসরের দক্ষিণ সমুদ্ৰ দিয়া নৌকারোহণে ঐ দেশে প্ৰথম আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করে - এ কথা মিসরিদের প্রাচীন গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে । মিসরের দক্ষিণে ভারত ভিন্ন অন্য প্রদেশ নাই । আবার দেখিতে পাওয়া যায় - দাক্ষিণাত্যের মাদ্রাজ্যাদি প্রদেশের দ্রাবীড়ির সহিত প্ৰাচীন মিসরির রং, ঢং, চেহারা, আচার, ব্যবহার এবং পূজ্য দেবদেবীর বিশেষ সাদৃশ্য বর্তমান - সেই শিবশক্তি পূজা, ষাঁড়ের সম্মান, বাবরি কাটা চুল, ধুতিপরা, কাছাহীন, মিস্‌কালো রঙ ! কাজেই কে না বলিবে - ঐ দ্রাবীড়িই মিসরে যাইয়া বহুপূৰ্বে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল ? পরে স্থলপথেও যে ভারতের সহিত মিসরের বাণিজ্য-সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল - এ বিষয়ের প্রমাণও প্রাচীনেতিহাস, এবং আসিয়ার অনেক স্থলে এখনও বর্তমান বণিক্‌কুলের যাতায়তের পথসমূহ (overland trade-routes) হইতে নির্ণীত হইয়াছে । খৃষ্টান-ধর্মপ্ৰবর্তক ঈশার ঐ মিসরে বহুকাল বাসের কথা বাইবেলের নবভাগে নিবদ্ধ । আবার কেহ কেহ বলেন -তাঁহার ভারতেও ধর্মশিক্ষার জন্য আগমন হইয়াছিল । যাহাই হউক, তৎপ্রচারিত মতের অধিকাংশই যে বৌদ্ধধর্ম এবং ইরাণি ধর্মপুস্তক ‘জেন্দাবেস্তা’ হইতে সংগৃহীত, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই; সেই ভালমন্দ দুই শক্তির দ্বন্দ্বে উত্তমের জয়, সেই উত্তমের অনুজ্ঞায় মন্দের মানবকে প্রলোভিত করিয়া পরীক্ষা, সেই উত্তমের কৃপাপরবশ হইয়া স্বয়ং নরশরীরাবলম্বনে মানবকৃতাপরাধের প্ৰায়শ্চিত্ত করণ ! আবার ঈশাশিষ্য ম্যাথুআ-লিখিত প্রচার বিবরণীতে গ্যালিলি প্রদেশস্থ শৈলপাদমূলে ঈশার ধর্মোপদেশ-সম্বন্ধী যে সকল কথা লিপিবদ্ধ আছে, অবিকল সেই সমস্ত কথাই বৌদ্ধগ্রন্থে লিপিবদ্ধ শ্ৰীভগবদবতার বুদ্ধের শৈলপ্রচারে বিবৃত রহিয়াছে । অতএব বৌদ্ধমতের কতক কতকও যে ঈশার মতমধ্যে প্রবিষ্ট আছে - তাহাও প্রমাণিত । ঈশাশিষ্য যোহন-লিখিত প্রচার-বিবরণীর পূর্বভাগে অতি অপরিস্ফুটভাবে লিপিবদ্ধ ভারতের চিরন্তন সম্পত্তি - নাদব্ৰহ্ম-বাদের কথাও এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য ।

পাশ্চাত্যভূমি এইরূপে ভারতের ধর্মালোকে পূর্ব পূর্ব যুগে উদ্ভাসিত হইতেছিল, এমন সময়ে জড়বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি আসিয়া উপস্থিত হইল; এবং উহারই ফলে ঐ ভূমিতে ধর্মালোক পরিক্ষীণ হইয়া জড়বাদের অধিকার বিস্তৃত হইল । জড়বাদী জড়শক্তির বিস্তৃত তত্ত্বলাভে তৎপ্ৰয়োগ-বিজ্ঞানমাত্ৰ-কুশলী । অতএব পাশববলোন্মোত্ত পাশ্চাত্যের ধর্মমীমাংসা এখন যে গীতানিবদ্ধ নিম্নোদ্ধৃত বচনের অনুরূপ হইবে, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে -
“অসত্যম প্ৰতিষ্ঠন্তে জগদাহুরানীশ্বরম্‌  ৷
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্‌ ৷৷
এতাং দৃষ্টিমষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ ৷
প্রভবন্ত্যুগ্ৰকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ ৷৷
কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং দম্ভমানমদান্বিতাঃ  ৷
মোহাদ্‌গৃহীত্বাসদ্‌গ্রাহান্‌ প্ৰবর্তন্তেহ শুচিব্ৰতাঃ ৷৷
চিন্তামপরিমেয়াঞ্চ প্ৰলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ ৷
কামোপভোগপারমা এতাবদিতিনিশ্চিতাঃ ৷৷” - [গীতা]
“ঈশ্বরই নাই, তা ঈশ্বর আবার জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন । কামই স্ত্রী-পুরুষের সংযোগ করিয়া জগৎ সৃষ্টির কারণ । কামোপভোগই জগতে পরম পদার্থ - এইরূপ নিশ্চয় করিয়া অল্পবুদ্ধি আসুরপ্ৰকৃতি ব্যক্তি অহঙ্কার অভিমানে মত্ত হইয়া ঐ ভোগ কি প্রকারে পাইবে, এই চিন্তাতেই অহরহ কালযাপন করে এবং নানা অসদুপায় অবলম্বনেও পরাঙ্মুখ হয় না ।”

অতএব ভারতের ঋষি এবং অবতারকুলের ঐ সম্বন্ধী মীমাংসার অনুসরণ না করিয়া পাশ্চাত্যের অনুসরণে যে আমাদের সমূহ ক্ষতি এবং কালে ধ্বংসের বিশেষ সম্ভাবনা, তাহা আর বলিতে হইবে না । অতএব পূর্ব হইতেই ঐ বিষয়ে আমাদের সাবধান থাকিতে হইবে । সৰ্বকালে সমাধিগত প্ৰত্যক্ষই ধৰ্মের মূল । ঐ প্রত্যক্ষভূমির আভাস আবার জনসাধারণ কেবলমাত্ৰ শ্ৰীভগবানের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ও অনুভাবয়িতা আপ্তপুরুষকুলের “পাবনং পাবনানাং” জীবনচরিতে, ও তদ্ভাবে গঠিত সিদ্ধকাম সাধকের জীবনে পাইয়াই উহাতে বিশ্বাসী হইয়া থাকে । ঐ রূপ পুরুষের দর্শন, স্পৰ্শন ব্যতীত ক্ষণস্থায়ী রূপরসাদিতেই নিবদ্ধদৃষ্টি, মায়াগ্ৰস্ত জীবকুলের মায়াতীত নিত্যানন্দের আভাস লাভ সুদূরপরাহত । আবার, “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী” — জড় ভাবিতে ভাবিতে লোকে জড় হইয়া যায় এবং সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্ৰীভগবানের চিন্তায় মানব তৎস্বরূপই প্ৰাপ্ত হয় । পাশ্চাত্যভূমির বহুকাল ঐ রূপ আপ্তপুরুষের পবিত্র-সন্দৰ্শনলাভ হয় নাই; তদুপরি জড়ের চিন্তাতেও বহুকালাতীত হইয়াছে । কাজেই ঐ দুৰ্দশা ! তবে ভারতের ধর্মালোক আবার বর্তমান যুগে শ্ৰীভগবানের অপার কৃপায় অসুরমতাবলম্বী পাশ্চাত্যে প্রবেশ করিয়াছে । সেজন্য আশা হয়, আবার পাশ্চাত্য ভারতকে ধর্মগুরুত্বে বরণ করিয়া, ধ্বংসের পথ হইতে প্ৰত্যাবৃত্ত হইবে এবং জগতের যথার্থ কল্যাণে ক্ৰমশঃ নিজশক্তি প্ৰয়োগ করিতে শিখিবে ।

দেববলে বলীয়ান্‌ ভারত চিরকাল ধর্মসাক্ষাৎকার করিতেই নিজ শক্তি প্রয়োগ করিয়াছে । ঐ চেষ্টা বা সাধনফলেই পূর্বোক্ত ধর্মবিশ্বাস সমূহের সত্যতা সম্বন্ধে সে সাক্ষাৎ প্ৰমাণ পাইয়াছে । ভারত দেখিয়াছে - সত্যই প্রতীকোপাসনা ও বিশ্বাসসহায়ে এই বহুকালগত সংসার-স্বপ্ন একদিন ভাঙ্গিয়া যায়; সত্যই সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের অন্ধকারময় গৃহ ঈশ্বরকৃপায় এক মুহুর্তে আলোক পূর্ণ হয় ! ভারত দেখিয়াছে — সত্যই, শ্ৰীভগবান পূর্ণচিদানন্দস্বরূপে সকলের হৃদ্দেশে জ্বলন্তভাবে বিদ্যমান থাকিয়া সকলকে ফিরাইতেছেন, ঘুরাইতেছেন, উদ্দেশ্যবিশেষে চালিত করিতেছেন -
“ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ৷
ভ্রাময়ন্‌ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ৷৷ – [গীতা]
সত্যই, কেবল তাঁহার শরণাপন্ন হইলে পূর্ণ শান্তি লাভ - “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায় !” - নতুবা আর অন্য উপায় নাই ।

যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকাবলম্বনে শ্ৰীভগবচ্ছক্তি মানবনয়নে প্ৰকাশিতা হইয়াছেন । বৈদিক যুগের তেত্রিশটি দেবপ্রতীক এইরূপে পৌরাণিক যুগে তিন শত তেত্ৰিশ কোটী দেবপ্রতীকে পরিণত । তাই বলিয়া কেহ না অনুমান করেন - ঐ তিন শত তেত্ৰিশ কোটী দেবকুলের প্রত্যেকেই এক সময়ে সমভাবে মানবমনে আপনি আপন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল । ধৰ্মেতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায় - ভিন্ন ভিন্ন কালে ভিন্ন ভিন্ন দেবপ্ৰতীকোপাসনা প্ৰবর্তিত হইয়া, ভারতে পূজালাভ করিয়া, মানবের ধর্মলাভের সহায়ক হইয়াছিল । মন্ত্রশাস্ত্ৰাদি পাঠে ঐরূপ কত দেবতার নাম মাত্র কেবল প্ৰাপ্ত হওয়া যায় । তাঁহাদের ধ্যান এবং পূজাপদ্ধতিসকল বর্তমানে লোপ পাইয়াছে । তিব্বত, চীন, জাপানাদি প্রদেশে ঐ সকল দেবতার পূজা প্রচার এখনও দেখিতে পাওয়া যায় ! ভারতের ধর্মপ্রচারক যে, বহু প্ৰাচীন যুগে ঐ সকল দেবপূজা ভারত হইতে উক্ত প্ৰদেশসকলে লইয়া গিয়াছিল, তাহাও বেশ বুঝিতে পারা যায় ।

বৌদ্ধযুগে শতদলে আসীন উজ্জল বুদ্ধমূর্তিই প্রতীকরূপে উত্তর ভারতের অনেক স্থলে অবলম্বিত হয় । ক্রমে উহাই শতদল মধ্যবর্তী উজ্জ্বলালোকে বা পদ্মান্তৰ্গত উজ্জ্বলকিরণবর্ষী মণিখণ্ডে পরিণত হয় । তিব্বতে এবং অন্যান্য বৌদ্ধদেশে এখনও উহাই যে, সাধকের ধ্যানাবলম্বন, তাহা “ওঁ মণিপদ্মে হু” ইত্যাদি মন্ত্রেই স্পষ্ট ব্যক্ত ।

বহির্জগতের পদার্থনিচয়ের ন্যায় শরীরাভ্যন্তরীণ নানা পদার্থও প্রতীকরূপে কালে অবলম্বিত হইয়াছিল । তাহার কতকগুলি এখনও বর্তমান এবং কতকগুলি অধুনা লোপ পাইয়াছে । হৃদয়পুণ্ডরীকের মধ্যাগত উজ্জল আকাশ বা “দহরাকাশ”, নয়নান্তর্বর্তী ছায়া বা ‘ছায়াপুরুষ’ ইত্যাদি ঐরূপে এককালে প্ৰতীকরূপে অবলম্বিত হইয়াছিল - তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের বেদান্তভাষ্যে ঐ সকলের বিশেষ উল্লেখ থাকায়, কালে উহাদের পূজা প্ৰচলন থাকা স্পষ্ট প্ৰতীত হয় ।

ক্ষিতি, অপ্‌, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম — এই ভূতপঞ্চের প্রত্যেকটি এবং অন্ন, প্ৰাণ, মন প্ৰভৃতিও যে কালে সূক্ষ্মদৰ্শী মানব কর্তৃক ব্ৰহ্মপ্ৰতীকরূপে অবলম্বিত ও উপাসিত হয় - এ বিষয়ের প্রমাণও উপনিষৎনিবদ্ধ “কং ব্রহ্মেত্যুপাসীত” - “খং ব্ৰহ্ম” - “অন্নং ব্ৰহ্ম” - ইত্যাদি বহুবিধ বচনাবলীতে উপলব্ধি হয় । শব্দপ্রতীক সুক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতরভাবে আলোচিত হইয়া ক্ৰমে মাণ্ডূক্যোপনিষৎ নিবদ্ধ গভীর প্ৰণবতত্ত্ব এবং নাদব্ৰহ্মবাদে পর্যবসিত হয় - তাহাও এ স্থলে উল্লেখযোগ্য । ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সহিত মনোগত পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাবের নিগুঢ় নিত্য সম্বন্ধ আলোচনা করিয়াই কালে ঐ বাদের উৎপত্তি হয়, এবং ক্রমে উহা বিশাল কায়া ধারণ করিয়া নাদ বা শব্দ হইতে জগদ্যুৎপত্তি নির্ধারিত করে ।

বাহ্যান্তরভেদে, কত প্রতীকের যে এইরূপে কালে কালে উদয় হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা হওয়া সুকঠিন । ঐ সমস্ত প্রতীকের অবলম্বনে যে যে শক্তি-প্ৰকাশ মানব অনুভব করিত, এক মহান্‌ ঈশ্বরবিশ্বাসে উপনীত হইয়া, কালে সে সকলকে তাঁহারই বিভূতিরূপে গণনা করিতে শিখিল । গীতার দশমাধ্যায়ে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ যে যে পদার্থে যে যে ভগবদ্‌বিভূতি দর্শনের উপদেশ অর্জুনকে করিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকটিই প্ৰাচীনকালে পৃথক্‌ পূজা পাইয়াছিল বলিয়া অনুমিত হয় ।

এইরূপে খণ্ড খণ্ড বাহ্য প্ৰতীক সমুদয় একত্রীভূত হইয়া, এক বিরাট্‌ দেবতনুতে এবং খণ্ড খণ্ড আন্তর প্রতীকসমূহ সমষ্টিভূত হইয়া এক মহান্‌ আন্তর প্রতীকে কালে পর্যবসিত হইল - মানব, বিশ্ব-বিরাট্‌ এবং কুলকুণ্ডলিনী শক্তির উপাসনা করিতে শিখিল । তত্তদালোচনা আমাদের অন্য সময়ে করিবার ইচ্ছা রহিল ।

_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment