Thursday, April 20, 2017

সূচিপত্র (Power-worship : Contents)

<Next>

ভারতে শক্তিপূজা


সূচীপত্র


1)নিবেদন 
4)শক্তিপ্রতীক


1) নিবেদন (Preface)


“ভারতে শক্তিপূজা”র প্রথমভাগ প্ৰকাশিত হইল । সাধারণে ইহার আদর দেখিলে, দ্বিতীয়ভাগ প্ৰকাশের ইচ্ছা রহিল । (গ্ৰন্থকারের এ অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই । তিনি বিগত ১৩৩৪ সালের ১লা ভাদ্র দেহ রক্ষা করেন ।)

শক্তিপূজা, বিশেষতঃ মাতৃভাবে শক্তিপূজা ভারতেরই নিজস্ব সম্পত্তি । মাতৃ ভিন্ন অন্য ভাবের শক্তিপূজার কিছু কিছু মাত্রই অন্যান্য দেশে লক্ষিত হইয়া থাকে । বাস্তবিক জগৎকারণকে ‘মা’ বলিয়া ‘জগদম্বা’ বলিয়া ডাকা একমাত্ৰ ভারতেই দেখিতে পাওয়া যায় । আবার বহুকাল পবিত্র ও সংযত ভাবে শক্তিপূজার ফলে ভারতের ঋষিরাই প্রথম জ্ঞাত হইয়া প্রচার করিয়াছেন যে, জগদম্বা সগুণা এবং নিগুণা উভয়ই । পুরুষ ও প্ৰকৃতি, ব্ৰহ্ম ও মায়া বলিয়া ভারতের দর্শনকার যে দুই পদার্থ জগতের মূলে নির্দেশ করিয়াছেন, উহা একই বস্তুর একই কালে বিদ্যমান, দুই বিভিন্ন ভাব বা প্ৰকাশবিশেষ । তবে দেশকলাবচ্ছিন্ন বা নামরূপাবলম্বনে সবাহ্যান্তৰ্জগৎ-উপলব্ধিকারী মানবমন একই কালে, একেবারে জগদম্বার ঐ দুই ভাব সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষ করিতে অক্ষম । কারণ মানবমন স্বভাবতঃ এমন উপাদানে গঠিত যে, উহা আলোকান্ধকারের ন্যায় পরস্পরবিরুদ্ধ দুইটি ভাবকে একত্রে একই সময়ে গ্ৰহণে অপারগ । সেজন্য দেশ কালাবচ্ছিন্ন সগুণ ভাবের উপলব্ধির সময় সে জগদম্বার নির্গুণ ভাব উপলব্ধি করিতে পারে না ; এবং সমাধি সহায়ে উচ্চ ভূমিকায় আরোহণ করিয়া যখন সে জগন্মাতার নির্গুণ স্বরূপের প্ৰত্যক্ষ করে, তখন আর তাহার নয়নে তাহার সগুণ ভাবের ও সগুণ-ভাবপ্রসূত জগতের উপলদ্ধি হয় না । তবে সমাধিভূমি হইতে নামিয়া পুনরায় সাধারণভাব প্রাপ্ত হইলেও তাঁহার সমাধিকালানুভূত জগদম্বার নির্গুণ ভাবের যে কতকটা স্মৃতি থাকিয়া যায়, তাহাতেই সে নিঃসংশয় বুঝিতে পারে, তিনি নির্গুণা ও সগুণা উভয়ই । সে জন্য জগৎকারণের স্বরূপসম্বন্ধীয় পূর্ণ সত্য উপলব্ধি করিবার একমাত্র পথই যে নির্বিকল্প সমাধিলাভ, একথা ভারতের সকল ঋষি ও দর্শনকারই একবাক্যে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন ।

প্রতীকাবলম্বনে শক্তিপূজা যে ঐ সমাধিলাভের সহায়ক, একথাও ভারতের ঋষি ও আচার্যেরা আবহমানকাল হইতে নিজের উপলব্ধি করিয়া জনসাধারণে প্রচার করিয়া আসিতেছেন । প্রশ্ন উঠিতে পারে — প্ৰতীক কাহাকে বলে ? শাস্ত্রকার বলেন আন্তর ও বাহ্য জগতের অন্তর্গত যে সকল বিশেষ শক্তিশালী পদার্থ মানবমনে স্বভাবতঃ  অন্তরের ভাব উদিত করিয়া তাহাকে জগৎ কারণের অনুসন্ধান ও সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষকরণে নিযুক্ত করে, তাহাকেই প্ৰতীক বলে । আর ধাতু, প্রস্তর বা মৃত্তিকাদি কোন প্রকারেই পদার্থ গঠিত কৃত্ৰিম মূর্তিবিশেষে, জগৎকারণের সৃষ্টিস্থিত্যাদি গুণরাশির আরোপ বা আবেশ কল্পনা করিয়া পূজাধ্যানাদি-সহায়ে জগন্মাতার সাক্ষাৎ স্বরূপের উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করাকেই প্রতিমাপূজা বলে । “আব্ৰহ্মণি ব্ৰহ্মদৃষ্ট্যানুসন্ধানং” — অর্থাৎ যাহা সসীমস্বভাবহেতু পূৰ্ণব্ৰহ্ম নহে, ঐ প্রকার কোন পদাৰ্থ বা প্রাণীকে ব্ৰহ্ম বলিয়া ধরিয়া লইয়া পূৰ্ণব্ৰহ্মের স্বরূপানুভূতির চেষ্টা করার নামই প্রতীক ও প্রতিমাপূজা ।

আবার স্বল্প চিন্তার ফলেই প্ৰতীতি হইবে যে প্ৰত্যেক প্ৰতীক বা প্ৰতিমার পশ্চাতে সাধক চিরকাল জগৎকারণের গুণ বা শক্তিবিশেষেরই পরিচয় পাইয়া বা আরোপ করিয়া তাঁহার পূজা করিয়া আসিয়াছে । অতএব অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্তসাধকগণ অগণ্য দেব-দেবীর মূর্তি অবলম্বনে আবহমানকাল ধরিয়া কোনও না কোনও ভাবে যে শক্তিপূজাই করিয়া আসিয়াছে এবং এখনও যে তাহাই করিতেছে, এ বিষয় বুঝিতে আর বিলম্ব হয় না । বাস্তবিক সাধক জগৎকারণকে পুরুষ বা স্ত্রী যে ভাবেই গ্ৰহণ করুক না কেন, তাহার নিজ প্ৰকৃতিগত সংস্কারের অধীন হইয়াই উহা করিয়া থাকে এবং ঐ ভাবাবলম্বনে জগৎকারণের শক্তিরই পূজা করিয়া থাকে ।

যে কোনও ভাবাবলম্বনে যে কোন প্রতীকেই জগচ্ছক্তির উপাসনা করা হউক না কেন, উহাতে সাধকের মনের সম্পূর্ণ অনুরাগ না পড়িলে, সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না । ঐ সম্পূর্ণ অনুরাগ বা ভক্তিই তাহাকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সর্বপ্রকার ভোগসুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করাইয়া সর্বপ্রকার স্বার্থানুসন্ধানের হস্ত হইতে বিমুক্ত করিয়া দেয় । যে ভাবাবলম্বনেই সাধক সাধনায় প্ৰবৃত্ত হউক না কেন এবং সাধনে প্ৰবৃত্ত হইবার পূর্বে তাহার মনে যতই স্বার্থপরতা এবং ভোগসুখেচ্ছা থাকুক না কেন, কোনরূপে একবার তাহার মনে আপনি উপাস্যের উপর একবিন্দু যথার্থ অনুরাগ উপস্থিত হইলে, আর তাহার বিনাশ নাই । ঐ অনুরাগসহায়ে তাহার ঐ ভাবাঙ্কুর ধীরে ধীরে পুষ্ট ও বর্ধিত হইতে থাকে এবং ঐ ভাবসিদ্ধির জন্য কালে তাহাকে সম্পূর্ণ স্বার্থবলি বা আত্মবলি দিতে সক্ষম করে । জগৎকারণের সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষের জন্য, প্ৰবল অনুরাগে, সর্বপ্রকার ভোগসুখ মন হইতে এককালে ঐরূপ ত্যাগ করাকে নানা দেশের ধর্মশাস্ত্ৰ নানাভাবে ও ভাষায় বৰ্ণনা করিয়াছেন । ঈশাহি ধর্মশাস্ত্ৰ বলিয়াছেন — ‘Death of the old man’ – পুরাতন মানবের মৃত্যু; ভারতের দার্শনিক বলিয়াছেন — ত্যাগ ও বৈরাগ্য-সাহায্যে মনের নাশ করা; তন্ত্রকার বলিয়াছেন - দেবীর সম্মুখে আত্মবলিদান দেওয়া; যোগী বলিয়াছেন - পূর্ণ একাগ্ৰতা বা চিত্তবৃত্তিনিরোধ । নানা জাতির ভিতর ঐরূপে ঐ একই মানসিক অবস্থা যে কত প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা করা সুকঠিন ।

ভারতের ঋষি এবং আচার্যেরা আবার ভিন্ন ভিন্ন প্ৰকৃতি বা সংস্কারবিশিষ্ট সাধকের পক্ষে জগৎকারণের ভিন্ন ভিন্ন ভাবাশ্রয়ে উপাসনা ইষ্ট বলিয়া প্রচার করিয়া তাহাদের প্রত্যেকের ভাবসিদ্ধির জন্য ভিন্ন ভিন্ন মার্গের উপাসনা নির্দেশ করিয়াছেন । এক ভাবের উপযোগী মার্গবিশেষের উপাসনার সহিত অন্যভাবোপযোগী অন্য মার্গের উপাসনার বিশেষ প্ৰভেদ যে বিদ্যমান, একথা আর বুঝাইবার আবশ্যকতা নাই এবং তজ্জন্যই গ্ৰাম্যকথায় যেমন বলে – ‘যে বিবাহের যে মন্ত্র, তাহার উচ্চারণ চাই’ - অথবা সাধক যে ভাবসিদ্ধি-বাসনায় উপাসনায় বদ্ধপরিকর হইয়াছে, তদুপযোগী মাৰ্গেই তাহার অগ্রসর হওয়া কর্তব্য । নতুবা ফলসিদ্ধি সুদূরপরাহত থাকিবে । বৈষ্ণবতন্ত্রোক্ত সখ্য, বাৎসল্যাদি ভাবসিদ্ধির জন্য ৺কালীপূজা করিয়া বীরাচারে ভোগরাগাদির অনুষ্ঠানে কখনই ফলসিদ্ধি হইবে না । “গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ” — ইত্যাদি মন্ত্র পাঠই করিলাম অথচ গুরুকে সুখী করিতে যথাসাধ্য সেবা ও অর্থব্যয়ে কুণ্ঠিত হইলাম, “স্ত্রিয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু” - “হে দেবি তুমিই যাবতীয় স্ত্রীমূর্তিরূপে আপনি প্রকাশিতা হইয়া রহিয়াছ” - ইত্যাদি চণ্ডীতে লিপিবদ্ধ স্তবাদি পাঠ করিয়াই আবার পরক্ষণে মাতা, জায়া বা দুহিতার উপর নির্দয় ব্যবহার করিলাম ! - ঐরূপেও ভাবসিদ্ধি হইতে পারে না । এই প্রকার সর্বভাবসিদ্ধি সম্বন্ধেই বুঝিতে হইবে । অতএব আপন গন্তব্য পথে নিষ্ঠা রাখা, ভাবের ঘরে চুরি না করা এবং জগদম্বার স্বরূপ উপলব্ধির সহায় হইবে বলিয়া যে ভাবে যে প্রতীকই অবলম্বন করিয়া থাকি না কেন, ঐ প্রতীকটিই তিনি - অপর সকল বস্তু ও ব্যক্তি তিনি নহেন - এরূপ সঙ্কীর্ণ ভাব যাহাতে মনে উদয় না হয়, তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখা — এই কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া অগ্রসর হইলেই প্ৰতীকোপাসনা অশেষ মঙ্গলের হেতু হইয়া চরমে সাধককে সমাধি-ধনে ধনী করিয়া থাকে ।

আর এক কথা — আমাদের পূর্বোক্ত বক্তব্য বিষয় পাঠকের সহজে হৃদয়ঙ্গম হইবে বলিয়া আমরা পুস্তকের স্থলে স্থলে ব্যবহারিক জগতের ইতিহাস-প্ৰসিদ্ধ ঘটনাবলী প্রভৃতি দৃষ্টান্তরূপে প্রয়োগ করিয়াছি । বর্তমান সময়ের বিপ্লবাদীরা অনেক সময়ে ঐ রূপে ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের ভাষাবরণে আপনাদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করায় কেহ না ভাবিয়া বসেন - আমরাও তদ্রূপ করিয়াছি বা আমাদের তাহাদের সহিত কিছুমাত্ৰ সহানুভূতি আছে । তজ্জন্য এস্থলে স্পষ্ট বলিয়া রাখা ভাল যে অশ্রদ্ধা, হঠকারিতা, অবিবেচকতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতাতেই ঐ দলের জন্ম । রাজার মনে অনর্থক সন্দেহ উৎপাদন করিয়া উহারা ভারতের সমগ্র রাজভক্ত প্ৰজার সমূহ অকল্যাণ ও ক্ষতি সাধিত করিয়াছে; উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় দিয়া ভদ্রবংশীয় বালকদিগকে হীন দস্যুতস্করাদিতে পরিণত করিয়াছে; এবং ধর্মের ভাণে স্বাৰ্থসিদ্ধি করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়া সত্য ও সমাধিপূত গৈরিক বসনে জুয়াচুরির কলঙ্ককালিমা অর্পণেও কুষ্ঠিত হয় নাই । ইউরোপীয়দিগের ভিতর একটি প্ৰবাদ আছে যে, ‘শয়তানও স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করিয়া থাকে ।’ ইহাদের অধিকাংশের পর পর কাৰ্যকলাপ দেখিয়া সহানুভূতি হওয়া দূরে থাকুক, ঐ কথারই মনে উদয় হয় । বলা বাহুল্য, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অসত্য কখনও কোন কালে, ধর্ম দূরে থাকুক, কোনও বিষয়েই উন্নিতিলাভের সোপান হইতে পারে না । অলমতিবিস্তরেণ - ইতি


_________________________________________
Scanned Copy Sources :

১) স্বামী সারদানন্দ, 1959 : "গীতাতত্ত্ব ও ভারতে শক্তিপূজা", প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ১৯৫৯, প্ৰকাশক : ভোলানাথ দাস, সপ্তর্ষি, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০৭৩; মুদ্রক : প্রিন্টার্স কর্নার,  ৪৫/এ রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০০৯

২) স্বামী সারদানন্দ, 1923 : "ভারতে শক্তিপূজা", চতুর্থ সংস্করণ, প্ৰকাশক : স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা; মুদ্রক : শ্রীসুরেশচন্দ্র মজুমদার, শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস, ৭১/১ নং মির্জাপুর স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩২১২৩

৩) স্বামী সারদানন্দ, 1928 : "ভারতে শক্তিপূজা", পঞ্চম সংস্করণ, প্ৰকাশক : ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১ নং মুখার্জি লেন, কলকাতা; মুদ্রক : শ্রীশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, বাণী প্রেস, ৩৩/এ, মদন মিত্রের লেন, কলকাতা

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.

Image Sources :
1) Cosmic Shakti
2) The Goddess

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Next>

শক্তিপ্রতীক - ৩ (Power-worship : Shakti Symbol-3)

<Previous--Contents--Next>

4.3) শক্তিপ্রতীক : নারী

(Power-symbol : Woman)

সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরেরও পূর্বের কথা - ইতিহাসের তখন জন্মই হয় নাই । - তবে কালনিৰ্ণয় আর করিবে কে ? জগতের সেই প্রাচীন যুগের অতি প্ৰাচীন কাহিনী সম্বন্ধে ইউরোপের বর্তমান কালের পুরাণজ্ঞ সূতকুল (antiquarian researchers) এই কথা বলিয়া থাকেন ।

বর্বর জগৎ তখন অজ্ঞানপ্ৰসূত নিবিড় অমানিশা সমাচ্ছন্ন । যে দিকে যতদূর দেখ, তমঃশক্তির সহিত রজঃশক্তির ঘোরতর দ্বন্দ্ব চলিয়াছে । মানবের মাসংপিণ্ডময় স্থূল দেহাপেক্ষা সমধিক শ্রেষ্ঠশক্তিসম্পন্ন অথচ তদন্তৰ্গত মনের ন্যায়, বহিঃপ্রকৃতির স্থূল সৃষ্টির অন্তৰ্গত শ্ৰেষ্ঠ সৃষ্টি - মানব-মানবীকে অধিকার করিয়াই পূৰ্বোক্ত দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে প্ৰকাশিত । প্ৰথম ক্ষুধার তাড়না, দ্বিতীয় অত্যধিক শীত, বাত, উষ্ণতাদি ও বন্য পশ্বাদির হস্ত হইতে আপনাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা, তৃতীয় আসঙ্গলিপ্সা, প্রভৃতি নানা প্রেরণায় মানব-মানবীর অন্তর্নিহিত রজোগুণ ক্রমশঃ বিশেষভাবে উদ্ধুদ্ধ এবং জীবন সংগ্রামে জয়ী হইতে লাগিল । আহারের নিমিত্ত ফলমূল অন্বেষিত হইল; যখন তাহা জোটা কঠিন হইল, তখন পশুবধ ও মাংসভোজন চলিতে লাগিল । গিরিগুহা, মৃৎস্তূপাদির সন্ধান এবং পরে শীত নিবারণ ও বাসের জন্য তদনুকরণে পর্ণাচ্ছাদন রচিত হইল হে দেবি মানবি ! - তমোগুণময়ী হইয়া আত্মস্বরূপ প্ৰকাশিত করিলেও তখন হইতেই তুমি সেই বর্বর নরের সহচরী !

ক্ৰমে অনিশ্চিত খাদ্যসঞ্চয়কে আয়ত্তাধীনে রাখিবার জন্য পশুপালন বৃত্তির প্রারম্ভ । মানবকুল তখন পূৰ্বাপেক্ষা অনেক বিস্তৃত - কিন্তু ঐ বিস্তারে এখনকার ন্যায় বিবাহ প্রথার নামগন্ধও নাই । আসঙ্গলিপ্সাই সে সম্মিলনে প্ৰজাপতি, কামই পুরোহিত এবং ছল-বল-কৌশলাদিই উহার মন্ত্র তন্ত্র । উহার কতকাল পরেও ‘দেবরেণ সুতোৎপত্তিঃ’ প্ৰভৃতি নিয়মে, এবং অতিবৃদ্ধ মনুর নয় প্রকারের বিবাহ এবং নয় প্রকার পুত্রের কথা লিপিবদ্ধ করাতেই পূর্বোক্ত বিষয় প্রমাণিত । নূহ বংশীয় লটের দুহিতাদ্বয় অপর পাত্রের অভাব দেখিয়া পিতাকেই মধুপানে মত্ত করিয়া গৰ্ভধারণ করিলেন ! [Genesis, XIX. 30-38] ঐরূপ আরও কত বিসদৃশ সম্মিলনে যে মানবকুলের প্রথম বিস্তৃতি, কে তাহার ইয়ত্তা করিবে ? নিত্য নিৰ্বিকার ঈশ্বর ভিন্ন, সে সকল বিপরীত সন্মিলন সম্মুখে দেখিলে আমাদের ন্যায় সামান্য জীবের কাহার মন না অসীম লজ্জা ও ঘৃণায় ম্রিয়মাণ হইয়া সমগ্ৰ মনুষ্যজাতিকেই শত ধিক্কার প্রদান করিবে !

এইবার এক প্রকারের স্বার্থচেষ্টা মানবকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দলবদ্ধ করিতে লাগিল । বন্য পশুকুল স্বজাতির সহিত একত্ৰ দলবদ্ধ থাকায় পরস্পরের কত সহায় হয় দেখিয়া এবং একাকী অপর বর্বর মানব ও হিংস্ৰ শ্বাপদকূলের হস্ত হইতে নিজ সহচরী ও পশু প্ৰভৃতিকে রক্ষা করিতে যাইয়া বারবার ক্ষতিগ্ৰস্ত হইয়া মানব বুঝিল - একত্র চেষ্টায় বলবৃদ্ধি, একত্ৰ বাসে বিশেষ লাভ । তখন মানব ক্রমশঃ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডলীতে আপনাকে নিবদ্ধ করিল; এবং মণ্ডলীর অন্তৰ্গত ব্যক্তি সকলের একত্র পশুচারণ, এবং রাত্রিকালে একই স্থানে পশু বন্ধন করায় একত্ৰ বাসের প্রথা প্ৰচলিত হইল । মণ্ডলীমধ্যগত সৰ্বাপেক্ষা বলবুদ্ধিশালী পুরুষের অন্য সকলের উপর প্ৰভুত্ব বিস্তৃত হইল এবং তাহারই নামে ঐ মণ্ডলী সর্বত্র পরিচিত হওয়াতে ‘গোত্ৰ’ সকলের উৎপত্তি হইল । গোত্ৰস্থ প্ৰত্যেক নারীই তখন গোত্রপতির বিশেষভাবে এবং গোত্ৰ মধ্যগত অপর সকল পুরুষের সমভাবে উপভোগের পদাৰ্থ বলিয়া পরিগণিত হইল । এইরূপে গোত্রের সহিতই নারীর প্রথম বিবাহ-সম্বন্ধ স্থাপিত হইল । দ্রৌপদীরূপিণী নারী তখন এককালে শত পতির মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত হইলেন ! অসহায় একক নরের সমসুখদুঃখভাগিনী পূৰ্বসহচরী তখন মণ্ডলী-বলপুষ্ট দর্পিত মানবের পাশবপ্রবৃত্তি-চরিতার্থ কুশলা পরাধীন দাসীমাত্রে পরিণত হইলেন ।

তখন গোত্ৰসকল আবার পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিল । এক গোত্র অপর গোত্রের নারী ও গোধন যখনই পারিল, ছলে বলে আত্মসাৎ করিতে লাগিল, এবং কখন বা যুদ্ধবিগ্রহে অপর গোত্ৰস্থ সকল পুরুষের নিধন সাধন করিয়া, তাহাদের যাবতীয় নারী ও পশু অধিকার করিয়া বসিল । ঐ রূপে অনেক গোত্রের নাম পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গেল ! অসহায়া অবলা নারী তখন বলবান মানবহস্তের ক্রীড়াপুত্তলি হইলেন । - দেবরাজ্ঞী শচীর ন্যায়, যখন যে ইন্দ্ৰত্ব লাভ করিল, হাস্যমুখে তাহারই বামে তখন উপবেশন করিয়া তাহারই মনোরঞ্জনে প্ৰবৃত্ত হইলেন !

এইবার পশুকুলের পালন ও খাদ্যসংগ্রহে সদলবলে দূরসঞ্চারী গোত্ৰকুল পশুপ্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হইল । এইরূপে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমশঃ বিস্তার হইয়া নিয়ত-পর্যটনশীল অনিশ্চিতাবাসস্থান মানবমণ্ডলীসকলকে বিশেষ বিশেষ জনপদে আবদ্ধ করিয়া ফেলিল । পল্লীগ্রামসমূহের উৎপত্তি হইয়া ক্ৰমে দেশসকলের সূচনা হইল । কিন্তু মানবের অবস্থার উন্নতি হইলে কি হইবে ?  হে দেবি মানবি, তোমার অবস্থার পরিবর্তন হইল না । দাসী দাসীই রহিল । পশু প্ৰভৃতি ধনের ন্যায় সৌন্দর্যভূষিতা নারী পাশব-বলদৃপ্ত মানব-প্রভুর অন্যতম রত্নমধ্যেই পরিগণিতা রহিলেন ।

ক্ৰমে বহু গোত্ৰসমূহ একই স্বার্থচেষ্টায় একত্র মিলিত হইয়া, ‘সুমের’ জাতির অভ্যুদয় এবং কালে বাবিলে সাম্রাজ্য স্থাপন । দমুজি ও আদুনেইয়ের পূজা প্রচারে সকাম প্রবৃত্তিমার্গের পূজার চূড়ান্ত অভিনয় ! জীবসৃষ্টিতে প্রয়োজনীয়তা নিত্য প্রত্যক্ষ করিয়া তন্ত্রশাস্ত্ৰে ‘পিতৃমুখ ও মাতৃমুখ’ স্বরূপে বর্ণিত যোনি ও লিঙ্গের উপাসনা-পদ্ধতি প্ৰবর্তিত হইল ! দেবীমন্দিরে পূর্বাপরিচিত পুরুষাঙ্কে শয্যা লাভ করা রূপ নারীর বিবাহপ্রথা প্ৰচলিত হইল !

নিয়ন্ত বর্ধমান ‘সুমের” জাতিরই এক ভাগ ক্ৰমে বাসের জন্য ‘সুজলা সুফলা’ ভূমিবিশেষের অন্বেষণে নিৰ্গত হইয়া স্ত্রী-পুং-চিহ্নের উপাসনাদি লইয়া ভারতে প্ৰবেশ করিল । অনেক কাল সমৃদ্ধিশালী হইয়া ভারতে বাসের পর উহারই এক শাখা আবার মালাবার উপকূল হইতে নৌযানে মিসরে যাইয়া নীলনদীতীরে অপর এক সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের সুচনা করিল ! এইরূপে ধন-ধান্যসম্পদ-গৌরবে পূৰ্বাপেক্ষা মানবের অনেক পদবৃদ্ধি হইল । মানবীর অন্তর্নিহিত দৈবী শক্তিও মানবের স্বীয় অবস্থোন্নতি-প্ৰবৃত্তির উত্তেজিকা হইয়া সর্বকাল সঙ্গে বাস ও তাহার সন্তানসন্ততি ধনজনাদির পালন ও রক্ষণে সহায়তা করিয়া সেই প্ৰাচীন যুগেই পৃথিবীর বহু স্থানে বহুভাবে বহুজন দ্বারা সকাম ভক্তির সহিত পূজিতা ও উপাসিতা হইলেন । সে উপাসনার মূলমন্ত্ৰ-মানবের স্বার্থসুখান্বেষণ, সে দেবীর প্রয়োজন - মানবের ভোগতৃপ্তি পর্যন্ত । কিন্তু ঐ্রররূপ হইলে কি হয় ? দুৰ্গন্ধাবিল পঙ্কাশ্রয়ে মধুগন্ধসমাকুল ফুল্ল দেবভোগ্য শতদলের ন্যায় মানবের ঐ ইন্দ্ৰিয়সুখৈষণা ভোগৈষণা ও আসঙ্গলিপ্সাপূর্ণ সাগ্ৰহ সকাম ভক্তি হইতেই কালে মানবমন নারী প্ৰতিমায় জগদম্বার হ্লাদিনী শক্তির উপাসনা করিতে শিখিল । ত্ৰিজগৎ-প্ৰসবিনী শক্তিকে কালে বিরাট নারীমূর্তি স্বরূপে কল্পনা করিয়া তদবলম্বনে জগন্মাতার উপাসনা করিয়া কৃতাৰ্থ হইতে শিখিল ।

প্ৰবৃত্তির জটিলারণ্যে মানব যখন ঐরূপে দিঙ্‌নির্ণয়ে অসমর্থ হইতেছিল, মানবীর শরীরমনের কমনীয় কান্তিকলায় সম্যগাকৃষ্ট হইয়াও যখন সে তাহার ভিতর “সূর্যকোটিপ্রতীকাশ চন্দ্ৰকোটিসুশীতল” দেবীমূর্তির সাক্ষাৎ পাইতেছিল না, তখন ভারতের দেবকুল দেবদ্রূমপরিশোভিত অভ্ৰভেদী হিমাচলশৃঙ্গে জগতের যাবতীয় নারীশরীরমনের সমষ্টিগঠিতা হৈমবতী উমার উজ্জ্বল কাঞ্চনাগৌরমূর্তির প্রথম সন্দর্শনে ধন্য হইলেন । দেবজগৎ স্তম্ভিতহৃদয়ে বালার্করূপিণী অনন্তকোটি-ব্রহ্মাণ্ডপ্ৰসবিনী ব্ৰহ্মশক্তি দেবী মানবীকে নীলাম্বরে সুখাসীনা দেখিলেন এবং তাঁহারই শ্ৰীমুখ হইতে তাঁহার মহিমাবাণী শ্রবণ করিলেন -

“অহং রাষ্ট্ৰী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাং
    * * *
ময়া সোহান্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্‌ ৷
অমন্তবো মাং ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ৷৷
    * * *
যং যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমি
তং ব্ৰহ্মাণং তমৃষিম্‌ তং সুমেধাম্‌ ৷” - [ঋক্, দেবীসুক্ত]

“আমিই সমগ্র জগতের রাজ্ঞী, আমার উপাসকেরাই বিভূতিসম্পন্ন হয়; আমিই ব্ৰহ্মা এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানসম্পন্না, সকল যজ্ঞে আমারই প্রথম পূজাধিকার; দর্শন, শ্রবণ, অন্নগ্ৰহণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসাদি প্ৰাণিজগতের সমগ্ৰ ব্যাপার আমার শক্তিতেই সম্পাদিত হয়; সংসারে যে কোন ব্যক্তি শুদ্ধভাবে আমার উপাসনা না করিয়া আমার অবজ্ঞা করে, সে দিন দিন ক্ষীণ ও কালে বিনষ্ট হয়; হে সখে, অবহিত হইয়া যাহা বলিতেছি শ্রবণ কর - শ্রদ্ধার দ্বারা যে ব্ৰহ্মবস্তুর সন্দর্শন লাভ হয়, আমিই তাহা; আমার কৃপাতেই লোকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে; আমার কৃপাকটাক্ষেই পুরুষ - স্রষ্টা, ঋষি এবং সুক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।”

দেবকুল হইতেই ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকুলে নারীমূর্তির কামগন্ধহীন পূজার প্রথম প্রচার । উপনিষৎ-প্ৰাণ ঋষি দেবীমহিমা প্ৰাণে প্ৰাণে প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিয়া গাহিলেন -
“অজামেকাং লোহিত শুক্লকৃষ্ণাং
বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ ৷
অজো হ্যেকো জুষমাণোহনুশেতে
জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ ॥”- [শ্বেতাশ্বতর]
“শুক্লকৃষ্ণরক্তবর্ণা সত্ত্বরজাস্তমোগুণময়ী, অনন্যসম্ভবা এক অপূৰ্বা নারী অনন্যসম্ভব এক পুরুষের সহিত সংযুক্ত থাকিয়া আপনার অনুরূপ বহু প্রকারের প্রজাসকল সৃজন করিতেছেন” - ইত্যাদি ।

আত্মস্বরূপে বর্তমান দেবীমহিমা প্ৰত্যক্ষ করিয়াই তিনি শিক্ষা দিলেন - “ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবত্যাত্মনস্তু কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবতি ।” - [বৃহদারণ্যক, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, ৫ম ব্ৰাহ্মণ, ৬]

“জায়ার ভিতরে আত্মস্বরূপিণী দেবী বর্তমানা বলিয়াই লোকের জায়াকে এত প্রিয় বলিয়া বোধ হয় ।”

ঋষিদিগের পদানুসরণে কৃতাৰ্থ হইয়া অতি বৃদ্ধ মনু আবার গাহিলেন -
“দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ ৷
অৰ্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্ৰভুঃ ॥” – [মনুসংহিতা ১-৩২]

সৃষ্টিপূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করিলেন ও সঙ্গত হইলেন । অতঃপর সেই নারী, বিরাট ব্ৰহ্মাণ্ডকে নিজ শরীর বলিয়া বোধ করিতেছেন যে পুরুষ, তাঁহাকে প্রসব করিলেন ।” বলদৃপ্ত মানব এতকাল আপনি সুখের জন্য, আপনি স্বার্থের জন্যই নারীর পালন ও রক্ষণ করিতেছিল; বৃদ্ধ মনু তাহাকে এখন নারীকে সহধৰ্মিণী জ্ঞানে সম্মানের চক্ষে দেখিতে শিখাইয়া তাহাকে নারীপূজায় আর এক পদ অগ্রসর করিলেন ।
“যত্ৰ নাৰ্য্যস্তু পূজ্যন্তে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ ৷
যত্ৰৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সৰ্বাস্তত্ৰাফলাঃ ক্রিয়াঃ ৷৷”
যে গৃহে নারীগণ পূজিত হন, সেই গৃহে দেবতাসকলও সানন্দে আগমন করেন; আর যে গৃহে নারীগণ বহুমান লাভ না করেন, সে গৃহে দেবতাদিগের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কোন ক্রিয়াই সুফল প্রসব করে না ।

এইরূপে ভারতের আর্যগৌরব ঋষিকুলই জগতে নারীমহিমা প্ৰথম অনুভব ও প্রচার করিলেন । সকাম জগৎ নির্বাক ও উদ্‌গ্রীব হইয়া তাঁহদের সেই পুতবাণী শ্রবণ করিল - মোহিতচিত্তে নারীপ্রতীকে কামগন্ধমাত্রহীন মাতৃপূজার, দেবীপূজার, তাঁহাদের সেই আয়োজন দেখিতে থাকিল এবং মুগ্ধ হইয়া তাঁহাদের যথাসম্ভব পদানুসরণ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইল । হে দেবি মানবি ! এইরূপে ভারতই তোমার দেবীমূর্তির নিষ্কাম পূজা জগতে প্ৰথম করিয়া ধন্য হইল - সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করিল ! ভারত সেই দিন হইতেই তোমায় কুলদেবীরূপে গৃহে গৃহে পুজা ও সম্মান করিতে থাকিল ।

সে সম্মান, সে শ্রদ্ধা ও পূজার ফলও ভারত প্ৰত্যক্ষ পাইল । সীতা, সাবিত্রী, দ্ৰৌপদী, দময়ন্তী প্রভৃতি হ্রীসৌন্দর্যভূষিতা উজ্জল দেবীপ্রতিমাসকল সৰ্বাগ্রে ভারতে পদার্পণ করিয়া দেশ পবিত্র করিলেন, পুণ্যময় ধর্মক্ষেত্রে পরিণত করিলেন । হে ভারত-সন্তান, বৈদেশিক অনুকরণে আজ কিনা তুমি নিজ কুললক্ষীর চরিত্র ও জীবন গঠনে অগ্রসর । অস্বাভাবিক শিক্ষা সম্পন্ন হীনবুদ্ধি বর্বর ! তোমার আধ্যাত্মিক দৃষ্টির কি অবনতিই হইয়াছে ! একবার বৈদেশিক মোহের নিবিড়াঞ্জন নয়ন হইতে অপসৃত করিয়া ভূতজগতে দৃষ্টিপাত কর – দেখিবে - জগতের আদর্শস্থানীয়া দিব্যনারীকুল একমাত্ৰ ভারতেই হিমাচলস্তরের ন্যায় অনুল্লঙ্ঘনীয় শ্রেণীতে তোমার কুললক্ষ্মীর সহায়তা করিতে দণ্ডায়মানা ! তাঁহাদের পদব্রজে কেবল ভারত নহে, কিন্তু সাব্ধিদ্বীপা সকাননা সমগ্ৰ পৃথিবীই সর্বকালের জন্য ধন্যা ও সগৌরবা হইয়াছেন । মূঢ় ! ভাব দেখি, ভারতের মৃত্তিকা - যাহাতে তোমার ও তোমার কুললক্ষ্মীর শরীরমন গঠিত হইয়াছে, ভারতের ধূলি - যাহা তোমার ও তাহার অঙ্গে আশৈশব লাগিয়া শরীর দৃঢ় করিয়াছে, তাহা সীতা, দ্ৰৌপদী, বুদ্ধৈকপ্ৰাণা যশোধরা, চৈতন্য-ঘরণী বিষ্ণুপ্রিয়া, ধর্মপ্ৰাণা অহল্যাবাই বা চিতোরের বীররমণীকুলের দেবারাধ্য পদম্পর্শে পবিত্ৰিত ! ভাব দেখি - ভারতের বায়ু - যাহা প্ৰতি নিশ্বাসে তোমাদের ভিতরে প্রবেশ করিয়া শরীর পুষ্ট করিতেছে, তাহা ঐ সকল দেবীদিগের পবিত্ৰ হৃদয়ে যুগে যুগে প্রবেশ লাভ ও ক্রীড়া করিয়া তাঁহাদের পবিত্রতায় ওতপ্রোতভাবে পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে ! - দেখিবে, তোমার, এ পাশ্চাত্য মোহ মরুমরীচিকার ন্যায় কোথায় সরিয়া গিয়াছে; আর উহা জলশূন্য বিজন মরুতে তোমাদের জলের প্রত্যাশায় ঘুরাইতে পরিবে না ! তোমার জগন্মাতা নারীকুলের উপর, বিশেষতঃ ভারতের রমণীকুলের উপর হৃদয়ের ভক্তি প্রেম উথলিত হইয়া তোমাকে আবার যথার্থ মনুষ্যত্বে প্ৰতিষ্ঠিত করিবে এবং তোমরা কুললক্ষ্মীকে সাক্ষাৎ দেবীপ্ৰতিমায় পরিণত করিবে ।

নারীর ভিতর জগৎপ্ৰসূতির বিশেষ বিকাশ প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিয়াই ভারতের দিব্যদর্শনসম্পন্ন ঋষিকুল মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন, নারী বুদ্ধিরূপা, শক্তিরূপা, জগজ্জননীর হ্লাদিনী, সৃজনী, ও পালনী শক্তির জীবন্ত প্ৰতিমাস্বরূপা । ঐ প্রত্যক্ষানুভব সৰ্বাঙ্গসম্পন্ন হইতে কিন্তু বহু সাধকের অনেককালব্যাপিনী সাধনার যে আবশ্যক হইয়াছিল, ইহা নিঃসন্দেহ । বৈদিক, ঔপনিষদিক ও দার্শনিক যুগের নারী-উপাসনার সহিত বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক যুগের ঐ বিষয়ের তুলনায় আলোচনা করিলে উহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় ।

বৈদিক ঔপনিষদিক যুগের নারী-উপাসনা ধীর, স্থির, শান্তভাবের । উহাতে উন্মত্ত প্রবাহের তাণ্ডবগতি নাই, অথবা ভীষণ আবর্তের প্রসারে উপাসকের চিত্তবিভ্ৰম উৎপন্ন করিয়া চিরকালের মত নিমগ্ন করিবার প্রভাব নাই। বৈদিক ঋষি পুরুষশরীরের ন্যায় নারীশরীরেও সমভাবে আত্মার বিকাশ অবলোকন করিয়া সর্ববিষয়ে পুরুষের সহিত নারীকে সমানাধিকার প্রদান করিয়া, তাঁহার পূজা ও সম্মান করিলেন । পরমাত্মার সাক্ষাৎ সন্দর্শনে এবং পবিত্ৰ স্পর্শে নারীও যে পুরুষের ন্যায় অতীন্দ্ৰিয় দিব্যদৃষ্টিসম্পন্না হইয়া ঋষিত্ব প্রাপ্ত হন, তাহা অবনতমস্তকে স্বীকার করিলেন । ঋক্‌ প্ৰভৃতি সংহিতা এবং উপনিষদের স্থানে স্থানে নারীঋষিকুলের উল্লেখ, জনকাদি রাজার সভায় ধর্মবিচারে গাৰ্গীপ্ৰমুখ নারীগণের পুরুষের সহিত সমভাবে যোগদানের উল্লেখ এবং অশ্বমেধাদি যজ্ঞক্রিয়ায় রাজার সহিত রাণীরও যোগদানের উল্লেখ থাকাই ঐ বিষয়ের যথেষ্ট প্রমাণ । এ তো গেল আধ্যাত্মিক জগতের কথা । ব্যবহারিক জগতেও নারীকুল পুরুষের সহিত যে বৈদিক যুগে সমসন্মান প্ৰাপ্ত হইতেন, তদ্বিষয়েরও বহু প্ৰমাণ পাওয়া যায় । তবে আমাদের কথায় কেহ যেন না ইহা বুঝিয়া বসেন যে, সংসারের কতকগুলি কার্যে যে নারীকুলেরই স্বভাবগত বিশেষাধিকার, এ কথা বৈদিক যুগে স্বীকৃত হইত না । উহা সর্বযুগেই ভারতে স্বীকৃত হইয়াছে এবং পরেও হইবে । তবে পাশ্চাত্য প্রদেশে খৃষ্ট জন্মিবার পাঁচ ছয় শতাব্দী পর পর্যন্তও যেমন নারীজাতিকে হেয়জ্ঞান করিয়া, তাহাদের ভিতর আত্মার অস্তিত্বই নাই, তাহারা পুরুষের ন্যায় কোনরূপ বিষয়সম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হইবার যোগ্যাই নহে, ইত্যাদি বিসদৃশ কথার স্বীকার এবং তদনুরূপ কার্যও সমাজের সর্ববিভাগে অনুষ্ঠিত হইত, বৈদিক যুগ হইতে কখন যে ভারতে এরূপ মত প্রচার ও কাৰ্যানুষ্ঠান হইয়াছিল, এবিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না ।

আবার বৈদিক যুগের বিবাহ প্ৰথায়, কুমারীকন্যার মাতৃত্বশক্তিবিকাশের অধিকারিণী হইবার প্রথম পরিচয়প্ৰাপ্তিমাত্ৰ “গৰ্ভং দেহি সিনীবালি” ইত্যাদি মন্ত্রে তাহার ‘মাতুমুখের’ পূজাদির বিধান থাকায় স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐকাল হইতেই ভারত নারীতে মাতৃপূজা করিয়া আসিতেছে । মাতৃমুখ বা স্ত্রীচিহ্নের বেদোক্ত ঐ পূজা যে দ্রাবিড়জাতির মধ্যগত স্ত্রীচিহ্নের পূজার বা তন্ত্রোল্লিখিত মাতৃমুখের পূজার ন্যায় ছিল না, ইহা বেশ বুঝিতে পারা যায় । উদ্দেশ্যের প্রভেদ দেখিয়াই ঐ কথা অনুমিত হয় । বৈদিকী পূজার উদ্দেশ্য কেবলমাত্ৰ মাতৃত্ব-শক্তির সম্মান; প্ৰাচীন দ্রাবিড়ি অনুষ্ঠানসকলের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র জায়ার ভিতর দিয়া প্ৰকাশিত নারীশক্তিরই পূজা; এবং তান্ত্ৰিকী পুজার লক্ষ্য, মাতা এবং জায়া উভয়ভাবে প্রকাশিতা নারীশক্তিরই মহিমা প্রচার ।

বেদে ঐরূপে নারীর মাতৃত্বশক্তির পূজাবিধান অল্পবিস্তর প্রাপ্ত হইলেও দ্রাবিড় জাতির ন্যায় স্ত্রী-পুংচিহ্নের উপাসনার কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না । পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, ঐ উপাসনা সুমের এবং তচ্ছাখা দ্রাবিড় জাতিরই নিজস্ব - বৈদিক আর্যদিগের নহে; নতুবা বেদেই উহার প্রমাণ পাওয়া যাইত । তিনি আরও বলিতেন, লিঙ্গাইত শৈবসম্প্রদায়, লিঙ্গোপাসনা বেদবিরুদ্ধ নহে এবং অথর্ববেদনিবদ্ধ যুপস্কম্ভের (স্তম্ভের) উপাসনাই লিঙ্গোপাসনা বলিয়া প্রচার করিয়াছেন । কিন্তু অনুধাবন করিয়া দেখিলে ঐ কথা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারা যায় না, কারণ যদি ঐরূপই হইবে, তবে বেদের অন্য কোন স্থলেই স্ত্রী-পুং-চিহ্নের পূজা-পরিচায়ক কোনও মন্ত্রবিধানাদি প্ৰমাণস্বরূপে পাওয়া যায় না কেন ? শিবলিঙ্গের পূজা যে পুং-চিহ্নের উপাসনা নহে, তাহার অন্য প্রমাণ উহার পূজাকালে পূজকের ‘ধ্যায়েন্নিতং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং’ ইত্যাদি মন্ত্রে ধ্যানধারণা করা । এজন্য বেদোক্ত বহুপ্রাচীন শিবপূজার এবং বৌদ্ধযুগের স্তূপসমূহের সহিত সংযোগ করিয়াই যে কালে বর্তমান লিঙ্গোপাসনা প্ৰবর্তিত হইয়াছে, ইহাই স্বামিজী যুক্তিযুক্ত মনে করিতেন ।

জায়ার ভিতর দিয়া প্ৰকাশিত নারীশক্তির দ্রাবিড়ি অনুকরণে পূজা বৌদ্ধযুগেই ভারতে প্ৰথম প্ৰবেশ লাভ করিয়াছিল; এবং কোনও নুতন ভাবের প্রথমোদয়ে লোকে যেমন উহাকেই সর্বেসৰ্বা ভাবিয়া সর্বত্র সকল কার্যেই উহার সংযোগ ও অনুষ্ঠান করিয়া থাকে, প্ৰায় সমগ্ৰ ভারত ব্যাপিয়া তদনুরূপ ভাবের অনুষ্ঠান হইয়াছিল । সেজন্যই দেখিতে পাওয়া যায়, বৌদ্ধযুগের তন্ত্ৰসকলের শিক্ষা - সকল রমণীর ভিতর কেবলমাত্র ঐ শক্তিরই সম্মাননা করা । সংযমী পুরুষসকলের ঐ শিক্ষায় কোনও ক্ষতি হইল না বটে - কিন্তু ঐ রূপ সংযমী পুরুষ কোনও জাতিবিশেষের ভিতর কয়টা দেখিতে পাওয়া যায় ? ইন্দ্ৰিয়াপরবশ অসংযমী ইতর-সাধারণ মানব ঐ শিক্ষা স্থূলভাবে গ্ৰহণ করিয়া বৌদ্ধযুগের শেষভাগে ভারতে যে কি অনাচার ব্যভিচারের স্রোত প্ৰবাহিত করিয়াছিল, তাহার আংশিক পরিচয় এখনও পুরী এবং দাক্ষিণাত্যের মন্দিরগাত্ৰস্থ বিপরীত পশুভাবসুচক মূর্তিগুলিতে দেখিতে পাওয়া যায় । ভারতের তন্ত্রকার সেজন্য অতি সাবধানে, অধিকারিভেদে রমণীর জায়াভাবের উপাসনার প্রবর্তনা করিয়া এবং বেদের অনুগামী হইয়া জনসাধারণে রমণীর মাতৃভাবের পূজারই বহুল প্রচার করিয়া বৌদ্ধযুগের ঐ দোষ পরিহার করিলেন । পঞ্চ 'ম'-কারসংযুক্ত তন্ত্রোক্ত বীরভাবের পূজা, যাহা সাধারণতঃ বামাচার বলিয়া কথিত হইয়া থাকে, তাহাতেই নারীর জায়াভাবের উপাসনা যে নিবদ্ধ রহিয়াছে, একথা আর বলিতে হইবে না । ঐ বীরভাবের প্রয়োগকুশল সিদ্ধগুরু এবং অনুষ্ঠানকুশল সংযমী শ্ৰদ্ধাবান্‌ সাধক - উভয়ই বিরল । উপযুক্ত গুরু লাভ করিয়া বিবাহিত ব্যক্তির ঐ ভাবের উপাসনায় উন্নতি লাভ হইতে পারে; কিন্তু যাহারা দারপরিগ্রহ করেন নাই, তাঁহাদের ঐ ভাবের উপাসনায় সহসা অগ্রসর হইলে পথভ্রষ্ট হইয়া পতন হইবারই বিশেষ সম্ভাবনা । সিদ্ধগুরু-সহায়ে সংযমী ব্যক্তিই কেবলমাত্র ঐ ভাবের উপাসনায় সিদ্ধকাম এবং উন্নত হইয়া থাকেন, একথা আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত ।

বামাচার” শব্দের অর্থ বুঝিলেই আমাদের পূর্বোক্ত কথা সহজে হৃদয়ঙ্গম হইবে । ‘বাম’ শব্দ এখানে ‘বিপরীত’ অর্থবাচক । অর্থাৎ পঞ্চ ‘ম’-কারাদি পদার্থ গ্রহণে ইতর-সাধারণে যে প্রকার উন্মত্তাবৎ অসংযত আচরণ করিয়া থাকে, তদ্বিপরীত আচরণযুক্ত হইয়া পূর্ণসংযমে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে সাধককে শিক্ষা দেওয়াই বামাচারের উদ্দেশ্য । অথবা ঐ সকল পদার্থের গ্ৰহণে ইতর-সাধারণ মানবের অধর্ম ভাবেরই উদ্দীপনা হইয়া থাকে; তদ্রূপ না হইয়া যাহাতে সুপ্তা কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হইয়া সাধককে অধিকতর সংযম, অধিকতর ধর্মভাব আনিয়া দেয়, তাহাই ঐ আচারের লক্ষ্য । আবার তন্ত্র বলেন, কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিত হইয়া মস্তকস্থ সহস্রারে উঠিবার সময় মূলাধার হইতে আরম্ভ করিয়া প্ৰতি চক্রকে বামাবর্তে পরিবেষ্টন এবং তচ্চক্রস্থ বর্ণসকলকে নিজাঙ্গে মিলিত করিয়া লয়েন এবং সমাধিভঙ্গের পর মস্তক হইতে পুনরায় মেরুচক্ৰে আসিবার সময় প্রতি চক্রকে বিপরীতভাবে অথবা দক্ষিণাবর্তে পরিবেষ্টন করিতে করিতে নিম্নে নামিয়া আসেন; কুণ্ডলিনী শক্তিকে ঐ রূপে জনসাধারণে অপরিচিত বামাবর্তে পরিভ্রমণ করাইয়া সহস্রারে উঠাইয়া সমাধিমগ্ন হইতে যে আচার শিক্ষা দেয়, তাহাই বামাচার - ঐ শব্দের উহাও, অন্যতম অর্থ । বামাচার শব্দের তন্ত্রোক্ত ঐ সকল অর্থের অনুধাবন করিলে বুঝিতে পারা যায়, উদাম উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্ৰয় দেওয়া, বামাচারের উদ্দেশ্য নয়; এবং কঠোরত্যাগী শ্ৰীগৌরাঙ্গ-প্রচারিত প্ৰেমধর্মকে যেমন বর্তমান কালের বাবাজী বৈরাগীদের ব্যভিচারের জন্য অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নহে, তেমনি ধৰ্মের নামে অনুষ্ঠিত বৌদ্ধযুগের এবং বর্তমান কালের ব্যভিচারসমূহের জন্য তন্ত্রোক্ত বামাচারকে দোষী নির্ধারণ করাও যুক্তিযুক্ত নহে ।

মানবপ্ৰেকৃতির স্বভাব পর্যালোচনা করিয়া আমরা বামাচারের সম্বন্ধে আর একটি কথাও সহজে বুঝিতে পারি । মানবকে যে বিষয়টির অনুষ্ঠান করিতে নিষেধ করা যায়, আমাদের মধ্যে এমন বিপরীতপ্রকৃতিবিশিষ্ট অনেক লোক আছে, যাহারা সেই বিষয়টিই অগ্ৰে করিয়া বসে । বামমার্গনিষিদ্ধ বস্তুসকলেরও ধৰ্মে একভাবে প্রয়োজনীয়তা আছে বলায়, ঐরূপ স্বভাববিশিষ্ট লোকসকলের ভিতরে পূর্বোক্ত প্ৰবৃত্তির উদয়ের পথ রুদ্ধ হইয়া যায় এবং ধর্মাচরণ করিতে আসিয়া তাহাদিগকে প্ৰবৃত্তির প্রেরণায় আর কপটাচায়ের আশ্ৰয় লইতে হয় না । বামমার্গের নিন্দাই সাধারণতঃ শুনিতে পাওয়া যায় । উহাতে যে কিছু ভাল আছে, একথা কাহাকেও বলিতে শুনা যায় না । আবার ঐ মার্গের সাধারণ গুরুরা অধিকারী নিৰ্বাচন না করিয়া সকলকেই ঐ পথের উপদেশ করিয়া সময়ে সময়ে অনেকের পতনের কারণ হইয়াছেন । তজ্জন্য আবার বামমাৰ্গকেই লোকে দোষী করিয়াছে । ঐ সকল কারণেই বামমার্গের পক্ষ সমর্থন করিয়া আমাদিগকে পূর্বোক্ত কয়েকটি কথা বলিতে হইল ।

ভারতের তন্ত্র ঐ রূপে নারীর মাতৃ ও জায়ারূপ উভয় ভাবের উপাসনার প্ৰবর্তনা করিয়া নারীপ্ৰতীকে বিশ্বজননীর উপাসনা সৰ্বাঙ্গ সম্পন্ন করিলেন, আর কুম্ভকার যেমন বাঁশ, বাখারি, খড়, মৃত্তিকাদিসহায়ে সুন্দর দেবমূর্তি গঠন করিয়া সাধকের পূজার সহায় হয়, ভারতের দার্শনিকগণ, বিশেষ আবার মহামুনি কপিল তদ্রূপ প্ৰকৃতিপুরুষবাদাদি নিজ নিজ মত প্রচারে তন্ত্রকারের সেই অসিমুণ্ড-বরাভয়করা, সৌম্যকঠোর, জীবনমৃত্যুরূপ সর্বপ্রকার বিপরীতভাবের সম্মিলনভূমিস্বরূপ মাতৃমূর্তির গঠনে সহায়তা করিলেন । তান্ত্রিক সাধক শ্রদ্ধা ও সংযম-সহায়ে ভক্তিপূরিতচিত্তে ঐ মূর্তির পূজা করিতে করিতে কালে সমাধিস্থ হইয়া দেখিলেন, বাস্তবিকই সে মূর্তি জীবন্ত, জাগ্ৰত, বিশ্বের সর্বত্র ওতপ্ৰোতভাবে পরিব্যাপ্ত । সমাধি-সহায়ে স্থূলবিশ্ব হইতে পৃথগ্‌ভাবে দূরে অবস্থিত হইয়া তিনি অনন্ত স্থূল ব্ৰহ্মাণ্ডের স্বরূপাকৃতি দেখিলেন - এক বিরাট শবশিবামূর্তি ! আর উহার মধ্যগত যত কিছু বিভিন্ন পদার্থ উহারা সকলেই সেই শবশিবার অঙ্গ-প্ৰত্যঙ্গ নখ-কেশ-লোমাদিরূপে নিত্য বিরাজমান । হৰ্ষ, বিস্ময়, ভয় প্ৰভৃতি অনন্ত ভাবে তাঁহার হৃদয় এককালে উদ্বেলিত হওয়ায় তাহার মুখ হইতে প্ৰথম বাক্য নিঃসৃত হইল -

করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুভুজাম্‌ ৷
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্‌ ৷৷
   * * *
এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং শ্মশানালয়বাসিনীম্‌ ৷

এইরূপে সমাধিমুখে বা ভাবমুখে প্ৰত্যক্ষ দর্শন করিয়াই যে সিদ্ধ সাধকেরা বিশ্বরূপিণী, বিশ্বজননীর বিবিধ রূপের ও বিবিধ ভাবের ধ্যান ও মন্ত্রাদি প্ৰাপ্ত হয়েন, এ বিষয় নিঃসন্দেহ ।

নারীর বিভূতি বা জায়াভাবের উপাসনা, পাশ্চাত্য বহু প্ৰাচীন কালে দ্রাবিড় জাতির নিকট হইতে প্ৰাপ্ত হইয়াছিল । তখন কারণপ্রিয়, ভূজগভূষিত উক্ষদেব (Bacchus) ও তচ্ছক্তি ঐশী (Isis) ইউরোপের নানাস্থানে নানাভাবে পূজা পাইতেন । বিরল সংযতমনা সাধকেরা শুদ্ধভাবে তাঁহাদের পূজা করিত । আর অসংযত উচ্ছৃঙ্খল ইতর-সাধারণ উহাদের পূজার নামে ব্যভিচারের প্ৰবল স্রোত পাশ্চাত্যের নানা স্থানে যে প্রবাহিত করিয়াছিল, ইতিহাস তাহা প্ৰমাণিত করে । উক্ষদেবের পূজায় নরনারীসকল গভীর নিশীথে গুপ্তচক্রে একত্র মিলিত হইয়া মদ্যপান এবং নানা অসংযতাচরণ যে করিত, প্ৰাচীন ইতিহাসে এ বিষয়েরও প্রমাণ পাওয়া যায় । তখনকার সম্ভ্রান্তবংশীয়া মহিলাদের ভিতরেও ঐরূপ পূজানুষ্ঠানের প্রচার ছিল । জগদ্বিজয়ী অসামান্য বীর আলেক্‌জাণ্ডারের মাতার ঐরূপ পূজানুষ্ঠানের কথা ইতিহাস-নিবদ্ধ । খৃষ্টধৰ্মের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত ঐ রূপ অনুষ্ঠানসকল যে অতি সাধারণ ছিল, ইতিহাস পাঠে ইহাও বুঝিতে পারা যায় ।

বৌদ্ধ ও ইরানী ধৰ্মের সারভাগ নিজাঙ্গে মিলিত করিয়া নবীন খৃষ্টধর্ম পূর্বোক্ত পূজার বিরোধী হইয়া দণ্ডায়মান হয় এবং কালে শার্লম্যান-প্রমুখ রাজন্যবৰ্গকে নিজ মতে দীক্ষিত করিয়া তাঁহাদের তরবারির সহায়েই নিজ প্রাধান্য স্থাপনে সমর্থ হয় । ছলে বলে কৌশলেই যে খৃষ্টধর্ম ইউরোপে প্ৰাচীন যুগে একাধিপত্য লাভ করে ইহা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ । সে যাহাই হউক, ঈশামাতা মেরীর পূজা প্ৰচলন করিয়া খৃষ্টধর্ম পাশ্চাত্যে প্ৰথম নারীর মাতৃভাবে পূজার কথঞ্চিৎ প্রচার করিয়াছিল । মাতৃপূজার ঐ বীজ কিন্তু ফলফুল-সমাচ্ছন্ন মহান মহীরুহে পরিণত হইয়া ভারতের ন্যায় পাশ্চাত্যকে প্রতি নারীর ভিতর ঐ ভাবের পূজা ও সম্মাননা করিতে শিখাইতে পারে নাই ।

ইউরোপের মাতৃপূজা ঐ মেরীমূর্তি পৰ্যন্ত যাইয়া আর অগ্রসর হইতে পারিল না । বহু প্ৰচীন উক্ষদেবের পূজাকাল হইতে নারীতে জায়াভাব বা শক্তিভাবের যে পূজা ও সম্মাননা করিতে ইউরোপ ক্ৰমে শিখিতেছিল, খৃষ্টধৰ্মের নবীন প্ৰবর্তনায় সে তাহা ছাড়িতে পারিল না । তবে কালে কথঞ্চিৎ শুদ্ধভাবে নারীর ঐ ভাবের পূজা করিতে শিখিল মাত্র ।

সমগ্ৰ পাশ্চাত্য যে ঐভাবে নারীজাতীর বিশেষ পূজা ও সম্মাননা করে, ইহা নিত্যপ্ৰত্যক্ষ । ইউরোপী পুরুষ নারীকে অগ্ৰে আসন, অগ্ৰে বসন, অগ্ৰে ভোজন দেয় । ট্রাম বা রেলগাড়ীতে স্থানাভাবে কোন রমণী দণ্ডায়মানা রহিয়াছেন দেখিলে, তৎক্ষণাৎ নিজে দাড়াইয়া আপন স্থানে তাঁহাকে বসিতে দেয় । যানারোহণের সময় রমণীদের অগ্ৰে উঠাইয়া পরে আপনি উঠে - ইত্যাদি নানা প্রকারে স্ত্রীজাতির সন্মাননা করিয়া থাকে । কিন্তু উপর উপর না দেখিয়া একটু তলাইয়া দেখিলেই উহা যে নারীর মাতৃভাবের পূজা নহে, শক্তিভাবের বা “গৃহলক্ষ্মী, ‘কুললক্ষ্মী’ ‘দেবী' ‘আনন্দময়ী’ প্রভৃতি শব্দনিহিত নারীর সংসারপালন, পুরুষ-নিয়ামক ঐশ্বর্যভাব - যে ভাব ঘনীভূত হইলে কালে মধুর বা জায়াভাবে পরিণত হয় - সেই ভাবেরই উপাসনা, তাহা সহজেই প্ৰতীয়মান হয় । কারণ, ইউরোপী পুরুষের ঐ পূজা ও সম্মান অপ্রাপ্তবয়স্ক কুমারী বা রূপযৌবনগলিত বৃদ্ধা নারী কদাচ পাইয়া থাকেন । সৰ্বাগ্রে যুবতী এবং পরে প্রৌঢ়া নারীগণই ঐ সন্মানের বিশেষ ভাবে অধিকারিণী । আবার রূপসৌন্দর্যভূষিত প্রৌঢ়ার সম্মুখে কুরূপ যুবতীও ঐ পূজায় নিম্নাসন পাইয়া থাকেন । আবার অপরিচিত পুরুষ অপরিচিত নারীকে সম্বোধন করিতে যাইয়া মাদাম (Madam) বা মিসিস (Mistress) প্রভৃতি যে সকল সম্মানসুচক শব্দ প্রয়োগ করেন, তাহাও যে নারীর শক্তিভাব বা ঐশ্বর্যভাবদ্যোতক তাহাও এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য । ইউরোপী পুরুষদিগের ঐরূপ আচরণ দেখিলেই আমাদের পূর্বোক্ত কথা হৃদয়ঙ্গম হইবে ।

ভারতের তন্ত্র শক্তিপূজায় নারীর মাতৃভাবের উপাসনার প্রাধান্যই যে প্ৰতিষ্ঠা করিয়াছেন, তাহা ভারতের পুরুষকুলের নারীজাতির প্রতি ব্যবহারেই স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় । এখানে বৃদ্ধা বর্ষীয়সী নারীই পুরুষের সম্মান অগ্ৰে পাইয়া থাকেন । রূপসৌন্দর্যভূষিত নারী স্বীয় স্বামীর জননীর অধীনে না থাকিলে নিন্দাভাগিনী হন । উদ্ধত বধূর পরামর্শে পুত্র যদি জননীকে কোনরূপে অবহেলা করেন বা তাঁহার মর্যাদা লঙ্ঘন করেন তো স্ত্রী-জিত অধর্মচারী বলিয়া নিন্দিত হইয়া থাকেন । অপরিচিতা রমণী প্রৌঢ়া হইলে ‘মা’, যুবতী হইলে কন্যাবাচী ‘বাছা’ বা ‘মা লক্ষী’ ইত্যাদি শব্দে অভিহিতা ও সম্মানিতা হয়েন । মাতাই সৰ্বাগ্রে পূজা পাইয়া থাকেন এবং মাতৃসম্বোধনে সম্বোধিত হইলেই রমণীকুল নিঃশঙ্কচিত্তে অপরিচিত পুরুষের সহিত বাক্যালাপ ও আবশ্যক হইলে তৎকৃত সেবা বা সাহায্যও গ্ৰহণ করিয়া থাকেন । অন্যান্য নানা বিষয়েও ঐরূপ আচরণ দেখিয়া নারীর মাতৃভাবের পূজা যে ভারতের কতদূর অস্থিমজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছে, তাহা বেশ অনুমিত হয় ।

জগৎকারণ ঈশ্বরকে ‘জগজ্জননী,’’ ‘জগদম্বা’ প্ৰভৃতি নামে অভিহিত করিয়া নারীভাবে উপাসনা করা ভারতেরই নিজস্ব সম্পত্তি । পাশ্চাত্য প্রভৃতি ভারতেতর দেশে ঈশ্বরের পিতৃভাবে উপাসনারই প্ৰচলন দেখা যায় । শুধু তাহাই নহে, খ্ৰীষ্টধর্মাবলম্বী বিশিষ্ট সাধকগণের অনেকে ঈশ্বরের নারীভাবারোপ করা মহাপাপের মধ্যে গণ্য করিয়া থাকেন । আবার নারীর শক্তিভাব বা ঐশ্বর্যভাবের বহুকাল হইতে উপাসনা করিয়া আসিলেও, ভারতের তন্ত্রোক্ত বামমার্গে যথাৰ্থ বীরসাধকগণের ন্যায় পাশ্চাত্যের কোন সাধকই ঐ ভাব ঈশ্বরে আরোপ করিয়া, তিনিই ‘আমার শক্তি’ - এই ভাবে তাঁহার উপাসনা করিতে সাহসী হন না । বহু প্ৰাচীন কালে ঐ ভাবের কিছু কিছু নিদর্শন ইউরোপী বিশিষ্ট সাধককুলের ভিতর পাওয়া যাইলেও, বর্তমানে উহার নামগন্ধও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । প্ৰাচীন যুগের ইউরোপীয় কোন কোন খৃষ্টান সাধিকার ঈশ্বরে বা ঈশ্বরাবতার ঈশায় পতিভাব আরোপ করিয়া সিদ্ধিলাভের কথা শাস্ত্রনিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায় । ঈশার ধ্যানে ও ভাবসমাধিতে তাঁহারা এমন তন্ময় হইতেন যে, ক্রুশারোহণকালে ঈশার যে যে অঙ্গ বিদ্ধ হইয়াছিল, তাহদের সেই সেই অঙ্গের সেই সেই স্থান হইতে শোণিত-নিৰ্গমনের কথাও লিপিবদ্ধ আছে । অপরদিকে আবার উপাস্য মেরীমূর্তির সহিত অঙ্গুরীয়-বিনিময় করিয়া তাঁহাকেই নিজশক্তি ভাবিয়া চিরকাল ব্ৰহ্মচর্য পালনের কথাও ইউরোপের প্রাচীন যুগের বিশিষ্ট সাধক-পণ্ডিত ইরাস্‌মসের জীবনচরিতে লিপিবদ্ধ আছে । ভারতের শক্তিপূজারই ভাবানুগত হইয়া যে ইউরোপের প্রাচীন যুগের ঐ সকল সাধকের ভিতর ঐরূপ ভাবসিদ্ধি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা ইতিহাসসহায়ে বেশ অনুমিত হয় । পরবর্তী যুগসকলে ভারতের সহিত ঐ সম্বন্ধ যত রহিত হইয়াছে, ততই ইউরোপ ঐ ঐ ভাবসহায়ে আধ্যাত্মিক জগতে অগ্রসর হইবার ও সিদ্ধিলাভ করিবার কথা ভুলিয়া গিয়াছে । তাহার উপর মার্টিন লুথার-প্ৰবর্তিত প্রটেস্ট্যাণ্ট ধর্ম, পূর্ণ ব্ৰহ্মচর্য ও সন্ন্যাসের বিরোধী হইয়া কেবলমাত্র নীতিসহায়ে মানবকে জীবন গঠন করিতে শিক্ষা দিয়া, ইউরোপের আধ্যাত্মিক জীবনের মূলে এককালে কুঠারাঘাত করিয়াছে । আবার, জড়বিজ্ঞানের প্রসারে ইউরোপের দৃষ্টি বর্তমানকালে কেবলমাত্র জড়েই নিবদ্ধ থাকায়, তাহাকে একেবারে ইহকাল-সর্বস্ব করিয়া তুলিয়াছে । কাজেই যে প্রকারেই হউক, সংসারের ভোগসুখ লাভই ইউরোপাদি পাশ্চাত্য দেশসমূহের এখন পরম পুরুষাৰ্থ বলিয়া বোধ হইতেছে । ইউরোপের আধ্যাত্মিক জীবনের এ গাঢ় অমানিশার কখনও অবসান হইবে কি না, তাহা ঈশ্বরই বলিতে পারেন । আশাভরসার মধ্যে কেবল ইহাই দেখা যায় যে, পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দের সহায়ে ভারতের ধর্মভাব বর্তমান যুগে পুনরায় আমেরিকা ও ইউরোপে কথঞ্চিৎ প্রবিষ্ট হইয়া ধীরে ধীরে পুষ্ট ও প্রসারিত হইতেছে ।

যুগাবতার ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যাবির্ভাবে নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজা ভারতে বর্তমান যুগে আবার বিশেষ সজীব হইয়া উঠিয়াছে । নারী প্রতীকে এমন শুদ্ধ ভাবের শক্তিপূজা জগৎ আর কখন দেখিয়াছে কি না সন্দেহ । জগন্মাতার ধ্যানসমাধিতে নিরন্তর তন্ময় হইয়া থাকা এবং তাঁহার প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করিয়া পঞ্চম বৰ্ষীয় শিশুর ন্যায় তাঁহার উপর সর্বদা সকল বিষয়ের জন্য সম্পূর্ণ, আত্মনির্ভর করা, সকল নারীর ভিতর জগদম্বার সাক্ষাৎ প্ৰকাশ উপলব্ধি করিয়া সকল সময়েই তাঁহাদের যথার্থ ভক্তিপূর্ণচিত্তে মাতৃসম্বোধন করিয়া তাঁহাদিগকে নিজ উপাস্য ইষ্টদেবতার মূর্তি বলিয়া জ্ঞান করা, বিবাহিত হইলেও প্ৰাপ্তযৌবনা পত্নীর সন্দর্শন মাত্ৰ মাতৃভাবের প্রেরণায় তাঁহাকে মূর্তিমতী সাক্ষাৎ জগদম্বারূপে দর্শন করিয়া মাতৃসম্বোধন করা এবং জবা বিল্বদল দিয়া তাঁহার শ্ৰীপাদপদ্ম পূজা করা, বেশ্যারমণীকুলের ভিতরেও জগন্মাতার দর্শনলাভ করিয়া তাঁহাদিগকে মাতৃসম্বোধনে সম্মানিত করিয়া সমাধিস্থ হওয়া, সর্বজনসমক্ষে ভক্তিপুতচিত্তে কুলাগারপ্রতীকে জগদ্‌যোনির পূজা করিয়া আনন্দে সমাধিমগ্ন হওয়া, তান্ত্রিকী পূজার উপকরণ ‘কারণ’ দেখিবামাত্র জগৎকারণের কথা মনে উদিত হইয়া প্ৰেমে ভক্তিতে বিহ্বল হইয়া পড়া এবং সর্বোপরি জগন্মাতার প্রেমে আত্মহারা হইয়া স্বার্থপর ভোগসুখ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া পূর্ণ ব্ৰহ্মচর্যে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকা - শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যময় জীবন ভিন্ন জগৎ আর কোথায়, কোন্‌ যুগে, কোন্‌ অবতারপুরুষের জীবনেই বা নারীপ্রতীকে শক্তিপূজার ঐরূপ জ্বলন্ত উচ্চাদর্শ দেখিয়াছে ? তাঁহার অলৌকিক জীবনালোকের সহায়েই, হে ভারত, তোমাকে এখন হইতে পবিত্ৰভাবে নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজার অনুষ্ঠান করিতে হইবে । হে ভারত-ভারতি, গুরূপদিষ্ট হইয়া পশু বা বীর যে ভাবাবলম্বনেই তোমরা নারীপ্ৰতীকে শক্তিপূজায় অগ্রসর হও না কেন, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পবিত্র জীবন সর্বদা সম্মুখে রাখিয়া তদনুষ্ঠান করিও এবং তাঁহার এই কথা হৃদয়ে স্থির ধারণা করিয়া রাখিও যে, ত্যাগ, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্যসহায়ে একাঙ্গী ভক্তিপ্ৰেমে সাধনায় প্ৰবৃত্ত না হইলে কোনও ভাবে পূজা করিয়াই জগন্মাতার দর্শন লাভ করিয়া কৃতাৰ্থ হইতে পরিবে না; জানিও ‘ভাবের ঘরে চুরি’ থাকিলেই ঐ পূজা বিপরীত ফল প্রসব করিবে !

হে বীর সাধক, তোমাকেই অধিকতর অবহিত থাকিতে হইবে । তোমাকেই ক্ষুরধারনিশিত দুৰ্গম পথ দিয়া অগ্রসর হইয়া নারীপ্রতীকে জগচ্ছক্তিরূপিণী জগদম্বার পূজা করতে হইবে । প্রবৃত্তির কুহকে ভুলিয়া তোমারই ধৈৰ্যচ্যুতি হইয়া পদস্খলিত হইবার অধিকতর সম্ভাবনা ! জানিও ভারতের তন্ত্রকার তোমার জন্য নিশিপূজার বিধান করিয়া তোমাকে দিবাপেক্ষা নিশিতেই অধিকতর অবহিত থাকিতে সঙ্কেত করিতেছেন - কারণ হিংস্ৰ শ্বাপদকুলের ন্যায় ভীষণ ইন্দ্ৰিয়গ্রাম নিশার তিমিরাবগুণ্ঠনেই নিঃশঙ্ক প্রচরণে সাহসী হইয়া উঠে । ভাবিও না, নিষ্কামভাবে নারীপূজা তোমার ভাবাশ্রয়ে হইবার নহে ! নিস্তেজ-ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাম বৃদ্ধ দম্পতির শরীরসম্বন্ধ উঠিয়া যাইয়া পরস্পরের প্রতি ঘনীভূত প্রেমসম্বন্ধে অবস্থিত হইবার কথা একবার স্মরণ কর । ভাবিয়া দেখ, পুরুষের নিকট রমণী তখন সখীভাবে পরিণতা; অথবা রমণীতে এবং জননীতে তখন আর বিশেষ প্ৰভেদ কোথায় ? কালধর্মে তাহারা তখন যে অবস্থায় উপনীত, অবহিত থাকিয়া সাধনাসহায়ে সৰ্বকাল নারীর সহিত তোমায় ঐ ভাবে অবস্থিত থাকিতে হইবে; তবেই তোমার ভাবসিদ্ধি উপস্থিত হইবে । বিপদ্‌সমূহ, কিন্তু তজ্জন্য তোমাকে তোমার গুরূপদিষ্ট মার্গত্যাগ করিতে বলিতে পারি না । যুগাবতার শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব কাহারও ভাব কখনও নষ্ট করেন নাই বা কাহাকেও তদ্রূপ করিতে শিক্ষা দেন নাই । অবহিত থাকিয়া, ত্যাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া, শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত শুদ্ধভাবে উপাসনায় রত থাকিলে তুমিও কালে জগদম্বার দর্শনইলাভে সিদ্ধকাম হইবে - গুরুভক্ত, শ্রদ্ধাবান্‌ সাধক, এই কথা তোমাকেও তিনি বার বার বলিয়া অভয় দিয়াছেন । অতএব জগদগুরুর শ্ৰীপাদুকার ধ্যান করিয়া, তাঁহার ঐ অভয়বাণী হৃদয়ে ধারণ কারিয়া, অবহিত হইয়া শক্তিপুজায় অগ্রসর হও-ধন্য হও ।

_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

শক্তিপ্রতীক - ২ (Power-worship : Shakti Symbol-2)


4.2) শক্তিপ্রতীক : দেব, মানব এবং অন্যান্য

(Power-symbols : God, Man & others)

সৰ্বকালে যে কোন বস্তু বা ব্যক্তি সাধককে গন্তব্যের নিকটবর্তী করিয়াছে বা ধর্মলাভের-নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব মানবাত্মা ও শ্রীভগবানের স্বরূপ জ্ঞানলাভের-সহায়ক হইয়া তদ্বিষয় উচ্চভাবসমূহ তাহার ভিতর উদ্দীপিত করিয়াছে, ভারত তাহাকেই প্ৰতীকরূপে অবলম্বন করিয়া উচ্চ হইতে উচ্চতর সত্যসোপানে আরোহণ করিয়াছে । সর্বদেশে সর্বজাতির ভিতরেই সত্যলাভের উহাই ক্ৰম । তবে, পৃথিবীর অন্য সকল জাতি নিম্ন সত্য হইতে উচ্চতর সত্যান্তরে উপনীত হইয়া প্রথমটিকে মিথ্যা বা ভ্ৰম বলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়াছে আর তাহার সহিত সম্পর্ক মাত্র রাখে না; শ্ৰদ্ধাসম্পন্ন ভারত তাহা না করিয়া অন্যরূপ করিয়াছে - কৃতজ্ঞতাপূর্ণহৃদয়ে ঐ নিম্ন সত্যকে যথাযথ স্থানে রাখিয়া - উচ্চাদর্শ গ্ৰহণে এবং তদ্বারা নিজ জীবন নিয়মিত করিতে এখনও অসমর্থ পুরুষসকলের কল্যাণের নিমিত্ত-চিরকাল উহার পোষণ ও পূজা করিায়াছে । ভারত উচ্চ উচ্চতর আদর্শসমূহ লাভে স্বয়ং কৃতাৰ্থ হইয়াই ভাবিয়াছে, এই “মই, বাঁশ, দড়ি বা সিঁড়ি অবলম্বনে আজ আমি সত্যসৌধের এই উচ্চ ছাদে আরোহণ করিলাম, কাল অন্য কেহও ত এই ছাদে উঠিবার সঙ্কল্প করিয়া আগমন করিতে পারে, তাহারও ত এই মই, বাঁশ, দড়ি বা সিঁড়ি অবলম্বন ভিন্ন গত্যন্তর নাই; অতএব তাহার বা তাহাদের সহায়তার জন্য উহা নষ্ট না করিয়া রাখিয়া দেওয়াই ভাল । ভারতের এই ভাবটিই শ্ৰীভগবান্‌ শ্ৰীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়া অমৃতময় গীতে এইরূপে চিরনিবদ্ধ করিয়াছেন :-
“ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্‌ ৷
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান যুক্তঃ সমাচরন্‌ ৷৷” - [গীতা]

জ্ঞানী সাধনফলে স্বয়ং ধর্ম বা ঈশ্বরজ্ঞানবিষয়ক উচ্চতম সত্যে আরোহণ করিয়াছেন বলিয়া দেশকালপাত্ৰভেদ বিচার না করিয়া, উহা জনসাধারণে প্রচার করিবেন না । কিন্তু অজ্ঞ ব্যক্তি দৃঢ়বিশ্বাসসহকারে শ্ৰীভগবানের উপাসনার নিমিত্ত যে যে কৰ্মের অনুষ্ঠানে রত, তৎসকলের অনুমোদন ও যথাসম্ভব আচরণ করিয়া, তাহার শ্রদ্ধা যাহাতে ঐ বিষয়ে আরও দৃঢ়ীভূত হয়, তাহাই করিবেন । কারণ, ধর্মগত উচ্চতম সত্যের ধারণা ব্যক্তিগত সাধনের পরিপক্কাবস্থায় আপনা আপনি উদয় হইয়া থাকে । কেবলমাত্ৰ কাহারও কথায় তল্লাভ কাহারও কথন হইবে না ।

ঐ ভাবটি লক্ষ্য করিয়াই শ্রীরামকৃষ্ণদেব আবার বর্তমান যুগে আমাদের শিক্ষণ দিয়াছেন — “কাহারও ভাব নষ্ট করতে নাই; ভাব নষ্ট করা মহা দোষ । যেমন ভাব - তেমন লাভ । ভাব আশ্রয় করিয়াই মানুষ সত্যবস্তু লাভ করে; কারণ, শ্ৰীভগবান স্বয়ং ভাবময় ! সোলার আতা বা হাতী দেখিলে যেমন সত্যের আতা ও হাতী মনে পড়ে, সেইরূপ মৃন্ময়ী, পাষাণময়ী মূর্তি দেখিলে চিন্ময়ী মূর্তির উদ্দীপনা হয়,” ইত্যাদি ।

শক্তিপূজার অবতারণায় আমরা প্ৰথমেই গুরূপাসনার উল্লেখ করিয়াছি । কেন না, গুরুপ্রতীকই সর্বপ্ৰতীকশ্রেষ্ঠ বলিয়া জনসমাজে পরিচিত হইয়া বর্তমান যুগে সৰ্বাগ্ৰে পূজিত হইয়া থাকে । হইবারই কথা - কারণ, শ্ৰীগুরুই ইষ্টমন্দিরের দ্বারস্বরূপ । দ্বাররুদ্ধ থাকিলে যেমন মন্দিরে প্রবেশ লাভ হয় না, শ্রীভগবানের গুরুশক্তি প্ৰসন্ন না হইলে, সেইরূপ মানবের ইষ্টদর্শনাশা বৃথা । মায়ানিরুদ্ধদৃষ্টি ভ্ৰান্ত মানবের চক্ষুরুন্মীলন করিবার জন্যই কৃপাপরবশ শ্রীভগবানের গুরুরূপে উদয় । সৰ্বদেশে সর্বকালে মানব যাহা কিছু সত্য বা জ্ঞান লাভ করিয়াছে বা করিবে, তাহা ঐ গুরুশক্তিপ্ৰভাবে । বাহ্যান্তরভেদে নানা প্ৰতীক অবলম্বনে গুরুশক্তিই প্ৰকাশিত হইয়া তাহাকে ধীরনিশ্চিত গতিতে দেশকালাবচ্ছিন্ন জগতে নিম্ন সত্য হইতে উচ্চতর এবং উচ্চতম সত্যে আরূঢ় করাইতেছে । আবার ঐ গুরুশক্তিই পূর্ণ স্বরূপে, সাত্ত্বিকবিগ্ৰহে মানবশরীর ও মানবীয় ভাবাবলম্বনে যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া, নিত্য নূতন নূতন ধর্মাদর্শ নিজ জীবনে প্রতিফলিত করিয়া, মানবকে সেই ছাঁচে জীবন গঠিত করিতে শিক্ষা দিয়া, দেশকালাতীত, কেবলানন্দরূপ সমাধিতে তুরীয় সত্যানুভবের উপায় সহজ ও সুখবোধ্য করিয়া দিতেছে ! সেইজন্যই উপনিষদে আপ্তকাম ঋষি গাহিয়াছেন, -
“যস্য দেবে পর ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ ৷
তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ৷৷” - [শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ]
“ইষ্টদেবের ন্যায় গুরুতে যাহার পরম ভক্তিশ্রদ্ধা, তাহারই নিকট পরম সত্য আপন স্বরূপ প্ৰকাশ করেন ।” সেই জন্যই কথিত আছে — “শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্ৰাতা, গুরৌ রুষ্টে ন কশ্চন ৷” - [গুরুগীতা]

দেবদেব উপেক্ষিত হইলে গুরুশক্তিসহায়ে মানব তাঁহার প্রসন্নতা পুনরায় লাভ করিতে পারে, কিন্তু দয়াঘনমূর্তি শ্ৰীগুরুশক্তি কোনও কারণে অপ্ৰসন্না হইলে, মানবের জ্ঞানলাভের দ্বার বহুকালের জন্য রুদ্ধ হইয়া গাঢ় অন্ধতম আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ফেলে - সে তমোগুণের হস্ত হইতে নিস্তার লাভ এক জীবনে কখনই সম্ভবপর হয় না । সেই জন্যই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার ইংরাজিভাবাপন্ন শ্রদ্ধানভিজ্ঞ বালশিষ্যমণ্ডলীকে নিজ শরীর দেখাইয়া বলিতেন - “দ্যাখ, এটা কেবল খোলমাত্র; এই খোলটাকে আশ্ৰয় করে শুদ্ধবোধানন্দময়ী মা লোকশিক্ষা দিচ্চেন; সেজন্য এর কাছে এলে, একে স্পর্শ কর্‌লে, এর সেবা কর্‌লে লোকের ধর্মভাবের উদ্দীপনা হয়ে ঈশ্বরলাভ হয়; কিন্তু খুব সাবধানে শ্রদ্ধার সহিত এটার সেবা কর্‌বি । শ্রদ্ধার অভাবে আমি রাগ করব না; কিন্তু এর ভিতর যে আছে, সে যদি অবজ্ঞাত হয়ে একবার ছুবলে দেয়, তা হলে জ্বালায় অস্থির হতে হবে ।” এক সময়ে কোন দুরন্তু শিষ্য নিজ ঘৃণিত জীবনালোচনায় ক্ষুব্ধ হইয়া দুঃখে অভিমানে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নানা অযথাভাষণ করে । অপার দয়ানিধি শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাহাতে তাহার জন্য বিশেষ চিন্তান্বিত হইয়া ব্যাকুলভাবে বলিয়াছিলেন, - “ওরে, ও আমাকে যা বলে, বলুক গে; (নিজ শরীর দেখাইয়া) এর ভিতরে যে আছে, তাকে ত কিছু বলে নি ? আমার চিদানন্দময়ী মাকে ত কিছু বলে নি ?”

হে ভারত, সাবধান ! গুরুশক্তিবলে বলীয়ান্‌ ! বিদেশী ভাবাপন্ন হইয়া আজ বিদেশী অনুকরণে শ্ৰীগুরুর পূজায় অবহেলা করিও না; আজি আট শত বৎসরের অধিক কাল হইল, নানারূপে নানাভাবে বিদেশী আসিয়া, কখন স্তুতিবাদ করিয়া, আবার কখন বা ভয় দেখাইয়া তোমাকে ঐ শক্তিপূজায় বিরত হইতে পরামর্শ দিতেছে - পাশব-বল প্রয়োগে বিধ্বস্ত করিয়া, দুঃখদারিদ্র্যনিপীড়িত তোমার পরিম্লান চক্ষের সমক্ষে নানা প্ৰলোভন আনিয়া একে একে ধরিতেছে । কিন্তু শ্ৰীগুরুশক্তিরই পরিণামে জয় ভাবিয়া, তুমিও এতদিন তাহা উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছ । সেজন্য বাবিল, মিসর, রোম, গ্রীস ও তুর্কাদি জাতিসমূহ দুৰ্জয় কালস্রোতে তৃণগুচ্ছের ন্যায় কোথায় ভাসিয়া যাইলেও, কৌপীনমাত্ৰাচ্ছাদিতকটি, তিতিক্ষাসম্বল, অনিত্যের ভিতর সর্বদা নিত্যদর্শনাভিলাষী, গুরুপাদনিবদ্ধদৃষ্টি ও তদনন্যশরণ তোমার সন্তানকুল সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া আজও বর্তমান ! তোমারই পুণ্যক্ষেত্রে আজও সর্বদেবদেবীস্বরূপ দিব্য গুরুশক্তি মানুষী তনু পরিগ্ৰহ করিয়া নিজমহিমা প্ৰকাশ করিয়া “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং” আবিভূর্তা হইতেছেন । তোমারই সন্তানকুলের সমষ্টিভূতমূর্তিস্বরূপ নরাবতার অর্জুন, কুরুক্ষেত্র-সমরের প্রথমাঙ্কে শ্ৰীগুরুপাদুকোদ্দেশে সর্বতোভাবে আত্মোৎসর্গ করিয়া কাতরকণ্ঠে যাহা বলিয়াছেন, -
“কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ, পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ ৷
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্ৰূহি তন্মে, শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্ৰপন্নম্‌ ৷৷” - [গীতা]
“হে প্ৰভু ! ভয়, মমতা প্ৰভৃতি নানা দুর্বলতায় আচ্ছন্ন হইয়া আমি, কি যে করা কর্তব্য, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না । আমার অহঙ্কার অভিমান দূর হইয়াছে - আমি এখন দয়ার পাত্ৰ । এ সময় যাহা করা কর্তব্য, যাহা করিলে আমার ও অন্যের মঙ্গল হয় এবং অধর্মাচরণ করা না হয় তাহাই আমায় বলিয়া দাও । আমি তোমার শরণাগত শিষ্য - আমাকে আশ্ৰয় দাও, পথ দেখাও ।”
- তাহা তোমার প্রত্যেক এবং সকল সন্তানের জন্যই উচ্চারিত হইয়াছিল । সে হৃদয়ের প্রার্থনা শ্ৰীগুরু-চরণপ্ৰান্ত সকলের জন্য সৰ্বকালের নিমিত্ত পৌঁছিয়াছে ! সে অভয়বাণী - “অহং ত্বাং সৰ্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ” - তোমার সন্তানের প্ৰত্যেককে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে দৈব-বলে বলীয়ান্‌ করিয়া রাখিয়াছে ! ধৈর্য ধর, পবিত্ৰভাবে নিৰ্ভীকহৃদয়ে তাঁহারই অনন্যশরণ হইয়া থাক - তোমাকে অবলম্বন করিয়া শ্ৰীগুরুর এখনও অনেক লীলা প্ৰকটিত হইবে ! দেখিতেছি না কি - অন্তর্জগতে, ধর্মজগতে তোমার সন্তান এখনও রাজা ? ইতিহাস-সহায়ে দেখ - সৰ্বকালে বৈদেশিক নিৰ্যাতন তোমার সন্তানের মাংসপিণ্ডময় ক্ষণভঙ্গুর শরীরটাকেই কয়েক দিনের জন্য মাত্ৰ নানাপ্রকারে ক্লিষ্ট করিতে পারিয়াছে - তাহার অমরাত্মাকে কে বাঁধিবে ? কে কখন তাহার অপ্ৰতিহত গতি রোধ করিয়াছে ? সত্যকে ধরিয়া, ন্যায়কে ধরিয়া ধৰ্মে সদা প্রতিষ্ঠিত থাক, জানিও -ভাব- জগৎই স্থূল জগৎটাকে ইচ্ছামত ভাঙ্গিতেছে, গড়িতেছে, পরিবর্তিত ও নিয়মিত করিতেছে; জানিও - কোন শৰ্বরীই চিরস্থায়ী নয় সকল অবস্থারই পরিবর্তন ধ্রুব । অহেতুকদয়াসিন্ধু শ্ৰীগুরুর পূজা প্রচলিত হইবার পূর্বেই কিন্তু ভারতে নানা প্ৰতীকের অভ্যুদয় হইয়াছিল । তত্তদ্বিষয়ের কিঞ্চিৎ আলোচনা না করিয়া, আমরা পুনরায় শক্তিপূজার সহায়ক অন্যান্য প্রতীকের কথা পাঠকের সম্মুখে আনয়ন করিব না ।

শ্ৰদ্ধাবাতাহতা, প্ৰেমবিকম্পভঙ্গিতা, বিজ্ঞানগুহাশায়িনী, প্ৰণবনাদিনী, চিরপাবনকরী, ভাবময়ী ধর্ম-গঙ্গার উৎপত্তিস্থান নিৰ্ণয় করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের অনেক মানবের অন্তঃস্থিত ভীতি-শৈলের শিখরদেশ নির্দেশ করিয়াছেন । আবার কেহ বা বলিয়াছেন – সৃষ্টিকল্পের প্রারম্ভে আদিম মানব বিচিত্র শক্তিশালী নানা পদার্থের সমষ্টিভূত – বিশ্ববিরাট্‌ দর্শনে বিস্ময়রসে আপ্লুত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন শক্তি প্ৰকাশের অবলম্বনসমূহের পশ্চাতে ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীর কল্পনা করিয়া হৃদয়ের পূজা অৰ্পণ করিয়াছিল; ঐ বিস্ময়-ভূধরের পাদমূলেই সনাতনী ধর্ম-ভাগীরথীর আদিম বিকাশ ! - উহাই প্রতীকোপাসনার বাস্তব মূল । ভারতের বেদগান ঐরূপেই প্ৰথমে সমুত্থিত হইয়া, জলদগম্ভীর সামধ্বনি ও পূতগন্ধী বিশ্বদেববলিধূমে সান্ধ্যগগন পূর্ণ করিয়াছিল ।

আমাদের ধারণা কিন্তু অন্যরূপ । চিজ্জড়সম্মিলনী, বিপরীতগুণধারিণী, বাহ্যান্তরপ্ৰতিঘাতিনী, উভয়মুখী মানবপ্রকৃতি সৰ্বকালেই এক বিষম জটিল রহস্য । সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের নানা ঘাতপ্ৰতিঘাত এবং ভূয়োদৰ্শন-সহায়েই তাহাতে নিত্য জীবেশ্বরসম্বন্ধ, পরলোকাস্তিত্ব, আত্মার চিন্ময়ত্ব ও অমরত্ব, সৃষ্টিপ্রবাহের অনাদিত্ব এবং দেববিগ্ৰহাদির বর্তমানত্বাদি-মূলক বিশ্বাসনিচয় একত্রীভূত হইয়া বর্তমান ধর্মবিশ্বাসরূপে প্ৰকাশিত হইয়াছে । জটিল মানবপ্ৰেকৃতির জটিল ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি জটিলভাবেই সাধিত হইয়াছিল । তুঙ্গশৃঙ্গ গিরিরাজি, সর্বগ্রাসকর জলধি, বিকটোল্লাস অশনি, নিশি-দিবাকর সূর্য, রাগরঞ্জিত উষা প্ৰভৃতি বাহিরের ভীষণ ও সুন্দর পদার্থনিচয়, যেমন জাগ্ৰদবস্থায় আদিম মানবের মনে ভীতিবিস্ময়াদি ভাবসমূহের উদয় করিয়া বাহ্য প্রতীকাবলম্বনে নানা দেবদেবীর পূজা করিতে তাহাকে শিখাইয়াছিল, সেইরূপ মোহময়ী নিদ্রারাজ্যে নিত্য প্রবিষ্ট হইয়া সে অঘটনঘটনপটীয়ান্‌ স্বপ্নের কুহকে যে সমস্ত অদৃষ্টপূর্ব দেশ, কাল, পাত্ৰাদির অনুভব করিত, ঐ সকলকে জাগ্ৰদনুভূত পদাৰ্থসকলের ন্যায় বাস্তব বলিয়া বিবেচনা করিয়া সে ইহলোক-ভিন্ন অপর এক লোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতে শিখিল । বাহ্যান্তরভেদে এইরূপে দুই প্রকার অনুভবের সহায়ে তাহার দুই প্ৰকার শিক্ষা যুগপৎ চলিয়াছিল বলিয়াই বোধ হয় ।

কালে সর্বরহস্যের উচ্চতম রহস্য মৃত্যুর সহিতও তাহার পরিচয় হইতে লাগিল এবং ক্রমে তাহার হৃদয়ঙ্গম হইল — মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যু সকলকেই একদিন গ্ৰাস করিবে । অধীর হৃদয়ে সে ভাবিতে লাগিল - এ কি ? এ আবার কোন দেবতা ? এইরূপে নচিকেতারূপী মানব মৃত্যুমুখেই ক্রমশঃ শিখিল - ইহকালেই তাহার অস্তিত্ব পর্যবসিত নহে - পরকাল আছে — এবং পরকালেও তাহার অস্তিত্ব সুনিশ্চয় । প্ৰেতাত্মাসকলের স্বপ্নে ও কখন কখন জাগ্ৰতে সন্দর্শনে তাহার ঐ পরকাল-বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হইল । জগতের সকল জাতির প্রাচীন পুরাণসংগ্রহে উক্ত প্রেতাত্মাকুলের দর্শনের কথা লিপিবদ্ধ আছে এবং এখনও ঐরূপে প্ৰেতাত্মাকুলের দর্শন যে সম্ভবপর, এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবার বহুলোক, কি প্রাচ্য, কি পাশ্চাত্য সকল ভূখণ্ডেই বিদ্যমান । ঐরূপ দৰ্শন হইতেই যে প্রাচীন যুগে পিতৃপুরুষের পূজা প্রচলিত হয়, এ বিষয় নিঃসন্দেহ । প্রাচীন মিসরে ঐ সকল প্ৰেতাত্মা ‘কা’ নামে নির্দিষ্ট হইত । ঐ ‘কা’ সকল, তাহাদের জীবিত সন্তানাদির নিকট আবির্ভূত হইয়া, স্ব স্ব দুঃখকষ্টের কথা জানাইত। “আমাদের অন্ন দে, বস্ত্ৰ দে, অন্য সব ভোগ্য পদার্থ দে” - ইত্যাদি বলিত; “না দিলে তোদের ধবংস করিব ।”-বলিয়া ভয় দেখাইত - এ সকল কথা তাহদের ভিতর লিপিবদ্ধ আছে । ভারতের পিতৃশ্ৰাদ্ধাদি, চীন ও জাপানের সিণ্টো-উপাসনা, ইউরোপ এবং আমেরিকার পূর্বের কথা ছাড়িয়া দিলেও বর্তমান যুগের ভূতুড়ে চক্রানুষ্ঠান (Spiritualism and Seance) প্রভৃতি ঐ বিষয়ের যথেষ্ট সাক্ষ্য ।

এইরূপে যত দিন না আদিম মানবের মনে পরকালবিশ্বাস সমুদ্ভূত হইয়াছিল, ততদিন যে সে ধর্মবিশ্বাসে ধনী হইয়াছিল, একথা বলা যায় না । আবার পরকালবিশ্বাস এবং বিভিন্ন শক্তির আধার নানা দেবদেবীতে বিশ্বাস যে তাহার মনে যুগপৎ উদয় হইয়াছিল -- একথাই যুক্তিসিদ্ধ বলিয়া বোধ হয় । প্ৰথমে ঐ সকল দেবদেবীর আবাস হিমালয়, সিনাই প্রভৃতি অত্যুচ্চ ভূধরশৃঙ্গে নির্ধারিত হয় । পরে মানব যখন সাহসাবলম্বনে ঐ সকল গিরিচুড়ার মস্তকে উঠিয়া তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াও ঐ সকল দেবদেবীর পরিচায়ক চিহ্নমাত্রেরও দর্শন পাইল না, তখন স্থির হইল, তাঁহারা কখন কখন ঐ সকল ভূস্বৰ্গে আগমন করেন মাত্ৰ - নতুবা তাঁহাদের চিরাবাসস্থল নানানক্ষত্ৰবিরাজিত ঐ সুনীল গগনের উপর ‘দ্যৌঃপিতরে’র অবস্থানভূমিতে, কৈলাসে, গোলোকে, কিন্নর-কিন্নরীশোভিত স্বৰ্গে, ইত্যাদি । আবার উচ্চাবচ পুণ্যপাপময় কৰ্মের কথা আলোচনায় উক্ত পরলোকবিশ্বাসও ক্রমে পিতৃলোক, দেবলোক, অন্ধতমোবিশিষ্ট লোক, নরক এবং তিৰ্যগ্‌যোনি প্ৰভৃতিতে মৃতব্যক্তিসকলের স্থান নির্ধারিত করিল ।

এইবার পৃথিবীতে বহুকাল বাস ও বহুদর্শনের ফলে মানবজাতির মধ্যে ভূতবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অঙ্কুরসমূহ ধীরে ধীরে উদ্‌গত হইতে লাগিল এবং ঐ সকল ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর শক্তি এক মহাশক্তিমানের লীলা বলিয়া অনুমিত হইয়া তাহাকে কালে এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসী করিয়া তুলিল । স্তম্ভিতহৃদয়ে মানব ভাবিল – যিনি সকলের নিয়ন্তা, -
“যস্য ব্ৰহ্ম চ ক্ষত্ৰঞ্চ উভে ভবত ওদনম্‌ ৷
মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্ৰ সঃ ৷৷” - [কঠোপনিষৎ]
“যাহারা ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় উভয়েই খাদ্যরূপে পরিগণিত, স্বয়ং মৃত্যু যাঁহার ঐ খাদ্যের উপযোগী ব্যঞ্জনসদৃশ, সেই কালান্তক বিশ্বদেবকে কে জানিতে সক্ষম ?”

কিন্তু এই খানেই শেষ হইল না ! এইবার ঔপনিষদিক যুগের প্রারম্ভ হইল । মানব ধ্যানাদি-সহায়ে জানিতে ছুটিল - সেই ঈশ্বর সৃষ্টির বাহিরে বা অন্তরে । প্ৰথমে স্থির হইল - তিনি সৃষ্টির বাহিরে - সৃষ্ট বিশ্ব হইতে অত্যন্ত বিভিন্নগুণবিশিষ্ট; জীব সেবক, তিনি সেব্য; জীব তাঁহাকে কখন ধরিতে ছুঁইতে পরিবে না ।

পরে স্থির হইল - তিনি সৃষ্টির অন্তরে ও বাহিরে - বিশ্ব তাঁহার একাংশে বর্তমান - “একাংশেন স্থিতো জগৎ"; জীব অংশ, তিনি পূৰ্ণ; দেহের সহিত ভিন্ন ভিন্ন অবয়বাদির সম্বন্ধের ন্যায় উভয়ে অবস্থিত । শেষে স্থির হইল - সসীম মন বুদ্ধির ভিতর দিয়া তাঁহাকে দেখিলেই তিনি বিশ্বরূপে আপাতপ্ৰতীত হন মাত্ৰ ! কোনক্রমে মনবুদ্ধিরূপ গণ্ডির বাহিরে যাইতে পারিলে তবে শুদ্ধ সত্যানুভব সাধ্য; সেখানে “একমেবাদ্বিতীয়ম্‌” - দুই তা নাইই, এক যে আছে, একথাও বলা যায় না; তিনি পূর্ণ, নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব । আর জীব ? - জীব বলিয়া কোন পদার্থ এখানে থাকিলেও সেখানে নাই ! - সাধকাগ্ৰণী শ্ৰীরামপ্রসাদ যেমন বলিয়াছিলেন –
“বেদের আভাস তুই ঘটাকাশ, ঘটের নাশকে মরণ বলে ।
ওরে শূন্যেতে পাপ পুণ্য গণ্য, মান্য করে সব খোয়ালে ।।
প্রসাদ বলে, যা ছিলি ভাই, তাই হবি তুই নিদানকালে ।
যেমন জলের বিম্ব জলে উদয়, জল হয়ে সে মিশায় জলে ।।”
তবে পাপপুণ্য, ধর্মাধর্ম, কর্মাকৰ্মের কারণ কি ? - যতক্ষণ শরীর, মন, বুদ্ধির গণ্ডির ভিতর, ততক্ষণ ওসকল সত্য; যেমন যতক্ষণ স্বপ্ন দেখা যায়, ততক্ষণ স্বপ্ন সত্য বলিয়া প্ৰতীত ।

তবে এ সংসার-স্বপ্ন মৃত্যু হইলেই কি ভাঙ্গিয়া যায় ? না - কোটি জন্মেও, বিজ্ঞানের উদয় না হইলে ভাঙ্গে না । আবার তীব্ৰ ইচ্ছাসহায়ে এক জন্মেই উহা ভাঙ্গিয়া দেওয়া যাইতে পারে।

এইরূপে সম্পূর্ণ ধর্মচক্ৰ ভারতে প্ৰবর্তিত হইল । বাকি রহিল মাত্ৰ - তৰ্কযুক্তিসহায়ে উহাকে মানব-মনের যথাসম্ভব বোধগম্য করা এবং সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ যাহাতে ঐ সত্যের দিকে অগ্রসর হইতে পারে, সেই ভাবে সমাজ গঠন । ভারতের কপিলাদি দার্শনিকগণ এবং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ হইতে আরম্ভ করিয়া বুদ্ধ, শঙ্করাদি অবতারনামা যত মহাপুরুষ অদ্যাবধি ভারতে শরীর পরিগ্ৰহ করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ঐ বিশয়ে সহায়তা করিয়াছেন ও করিতেছেন । সে অনেক কথা - কিন্তু ইহা তাহার স্থান নহে ।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের ধর্মসম্বন্ধীয় গবেষণা পাঠ করিলে উহাতে বিশেষ অঙ্গহানি লক্ষ্য হইয়া থাকে । হইবারই কথা । কারণ, পাশ্চাত্যপ্ৰদেশ এতকালেও কর্মী ভিন্ন একজনও বিশিষ্ট ধর্মবিজ্ঞানীর জন্মদানে সক্ষম হইল না । প্ৰাচ্যভূমি আসিয়া, বিশেষতঃ ভারত হইতেই ধর্মালোক যে পাশ্চাত্যে পূর্ব পূর্ব অতীত যুগে বরাবর সঞ্চারিত হয়, এ বিষয়ের সত্যতা, পৃথিবীর প্রাচীনেতিহাস যতই অলোচিত হইবে, ততই প্ৰমাণিত হইবে - ততই মানব বুঝিতে পারিবে, হিন্দুর নিত্য-পূজ্য বেদ হইতেই ধর্মালোক পৃথিবীর সর্বত্র বিকীর্ণ হইয়াছে । খৃষ্ট জন্মিবার সহস্ৰ বৎসরেরও অধিক কাল পূর্বে যখন গ্ৰীকজাতি বিশেষ বলদৃপ্ত হইয়া অন্যান্য সকল জাতিকে পাশব-বলে আপনি অধীনে আনিতে ব্যস্ত, তখন হইতে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার আদিগুরু গ্রীসের সহিত ভারতের সম্বন্ধবিস্তারের কথা ইতিহাস স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছে । তাহার পূর্বে যে সম্বন্ধ ছিল না একথাও স্পষ্ট বলা যায় না । ভারতের ধর্মপ্রচারক এবং কোন কোন স্থলে ভারতের বণিককুলও যে, ঐ কাল হইতে গ্রীস এবং তৎসন্তান রোম সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল, এ বিষয়েও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে । পালিস্তানের আন্টিয়ক্‌ শহরে ভারত-সম্রাট্‌ ধর্মাশোকের ধর্মশাসনক্ষোদিত প্ৰস্তরস্তম্ভ ঐ বিষয়ের জ্বলন্ত নিদর্শনস্বরূপ এখনও দণ্ডায়মান । ইউরোপের উল্লেখযোগ্য প্ৰথম দার্শনিক ‘পিতাগোরসে’র-নাম এবং সংখ্যা হইতে জগদ্যুৎপত্তিরূপ দার্শনিক মতে ভারতের পুতগন্ধের বিশেষ অনুভূতি হয় । কে না জানে — ভারতের সাধু ও আচার্যকুল অদ্যাবধি “পিতা, গুরু’ শব্দাদিতে জনসাধারণ কর্তৃক অভিহিত হন ? কে না জানে - শ্ৰীভগবদবতার মহামুনি কপিল চতুৰ্বিংশতি তত্ত্ব হইতে জগদ্যুৎপত্তি নির্ণয় করিয়া, আপন মীমাংসা ‘সাংখ্য” নামে জনসাধারণে প্রচারিত করেন ? সংখ্যা হইতেই যে উক্ত সমাধান ‘সাংখ্য’ শব্দে অভিহিত - একথা আর কাহাকেও বলিয়া দিতে হইবে না । এইরূপে গ্ৰীসরোমের ভিতর দিয়া যে ভারতের ধর্মমতসমূহই পূর্ব পূর্ব কালে প্রচারিত হইয়াছিল - এ বিষয়ের প্ৰমাণসংগ্ৰহ দিন দিন বৃদ্ধি হইতেছে ।

প্ৰাচীন ইউরোপে ধর্মালোক-বিস্তারের আর এক কেন্দ্র ছিল মিসর । ঐ মিসরও যে ভারতের ধর্মালোকে দীপ্ত হইয়াছিল - এ বিষয়েও অনেক প্ৰমাণ পাওয়া যাইতেছে । প্ৰাচীন মিসরি মিসরের দক্ষিণ সমুদ্ৰ দিয়া নৌকারোহণে ঐ দেশে প্ৰথম আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করে - এ কথা মিসরিদের প্রাচীন গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে । মিসরের দক্ষিণে ভারত ভিন্ন অন্য প্রদেশ নাই । আবার দেখিতে পাওয়া যায় - দাক্ষিণাত্যের মাদ্রাজ্যাদি প্রদেশের দ্রাবীড়ির সহিত প্ৰাচীন মিসরির রং, ঢং, চেহারা, আচার, ব্যবহার এবং পূজ্য দেবদেবীর বিশেষ সাদৃশ্য বর্তমান - সেই শিবশক্তি পূজা, ষাঁড়ের সম্মান, বাবরি কাটা চুল, ধুতিপরা, কাছাহীন, মিস্‌কালো রঙ ! কাজেই কে না বলিবে - ঐ দ্রাবীড়িই মিসরে যাইয়া বহুপূৰ্বে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিল ? পরে স্থলপথেও যে ভারতের সহিত মিসরের বাণিজ্য-সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল - এ বিষয়ের প্রমাণও প্রাচীনেতিহাস, এবং আসিয়ার অনেক স্থলে এখনও বর্তমান বণিক্‌কুলের যাতায়তের পথসমূহ (overland trade-routes) হইতে নির্ণীত হইয়াছে । খৃষ্টান-ধর্মপ্ৰবর্তক ঈশার ঐ মিসরে বহুকাল বাসের কথা বাইবেলের নবভাগে নিবদ্ধ । আবার কেহ কেহ বলেন -তাঁহার ভারতেও ধর্মশিক্ষার জন্য আগমন হইয়াছিল । যাহাই হউক, তৎপ্রচারিত মতের অধিকাংশই যে বৌদ্ধধর্ম এবং ইরাণি ধর্মপুস্তক ‘জেন্দাবেস্তা’ হইতে সংগৃহীত, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই; সেই ভালমন্দ দুই শক্তির দ্বন্দ্বে উত্তমের জয়, সেই উত্তমের অনুজ্ঞায় মন্দের মানবকে প্রলোভিত করিয়া পরীক্ষা, সেই উত্তমের কৃপাপরবশ হইয়া স্বয়ং নরশরীরাবলম্বনে মানবকৃতাপরাধের প্ৰায়শ্চিত্ত করণ ! আবার ঈশাশিষ্য ম্যাথুআ-লিখিত প্রচার বিবরণীতে গ্যালিলি প্রদেশস্থ শৈলপাদমূলে ঈশার ধর্মোপদেশ-সম্বন্ধী যে সকল কথা লিপিবদ্ধ আছে, অবিকল সেই সমস্ত কথাই বৌদ্ধগ্রন্থে লিপিবদ্ধ শ্ৰীভগবদবতার বুদ্ধের শৈলপ্রচারে বিবৃত রহিয়াছে । অতএব বৌদ্ধমতের কতক কতকও যে ঈশার মতমধ্যে প্রবিষ্ট আছে - তাহাও প্রমাণিত । ঈশাশিষ্য যোহন-লিখিত প্রচার-বিবরণীর পূর্বভাগে অতি অপরিস্ফুটভাবে লিপিবদ্ধ ভারতের চিরন্তন সম্পত্তি - নাদব্ৰহ্ম-বাদের কথাও এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য ।

পাশ্চাত্যভূমি এইরূপে ভারতের ধর্মালোকে পূর্ব পূর্ব যুগে উদ্ভাসিত হইতেছিল, এমন সময়ে জড়বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি আসিয়া উপস্থিত হইল; এবং উহারই ফলে ঐ ভূমিতে ধর্মালোক পরিক্ষীণ হইয়া জড়বাদের অধিকার বিস্তৃত হইল । জড়বাদী জড়শক্তির বিস্তৃত তত্ত্বলাভে তৎপ্ৰয়োগ-বিজ্ঞানমাত্ৰ-কুশলী । অতএব পাশববলোন্মোত্ত পাশ্চাত্যের ধর্মমীমাংসা এখন যে গীতানিবদ্ধ নিম্নোদ্ধৃত বচনের অনুরূপ হইবে, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে -
“অসত্যম প্ৰতিষ্ঠন্তে জগদাহুরানীশ্বরম্‌  ৷
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্‌ ৷৷
এতাং দৃষ্টিমষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ ৷
প্রভবন্ত্যুগ্ৰকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ ৷৷
কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং দম্ভমানমদান্বিতাঃ  ৷
মোহাদ্‌গৃহীত্বাসদ্‌গ্রাহান্‌ প্ৰবর্তন্তেহ শুচিব্ৰতাঃ ৷৷
চিন্তামপরিমেয়াঞ্চ প্ৰলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ ৷
কামোপভোগপারমা এতাবদিতিনিশ্চিতাঃ ৷৷” - [গীতা]
“ঈশ্বরই নাই, তা ঈশ্বর আবার জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন । কামই স্ত্রী-পুরুষের সংযোগ করিয়া জগৎ সৃষ্টির কারণ । কামোপভোগই জগতে পরম পদার্থ - এইরূপ নিশ্চয় করিয়া অল্পবুদ্ধি আসুরপ্ৰকৃতি ব্যক্তি অহঙ্কার অভিমানে মত্ত হইয়া ঐ ভোগ কি প্রকারে পাইবে, এই চিন্তাতেই অহরহ কালযাপন করে এবং নানা অসদুপায় অবলম্বনেও পরাঙ্মুখ হয় না ।”

অতএব ভারতের ঋষি এবং অবতারকুলের ঐ সম্বন্ধী মীমাংসার অনুসরণ না করিয়া পাশ্চাত্যের অনুসরণে যে আমাদের সমূহ ক্ষতি এবং কালে ধ্বংসের বিশেষ সম্ভাবনা, তাহা আর বলিতে হইবে না । অতএব পূর্ব হইতেই ঐ বিষয়ে আমাদের সাবধান থাকিতে হইবে । সৰ্বকালে সমাধিগত প্ৰত্যক্ষই ধৰ্মের মূল । ঐ প্রত্যক্ষভূমির আভাস আবার জনসাধারণ কেবলমাত্ৰ শ্ৰীভগবানের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা ও অনুভাবয়িতা আপ্তপুরুষকুলের “পাবনং পাবনানাং” জীবনচরিতে, ও তদ্ভাবে গঠিত সিদ্ধকাম সাধকের জীবনে পাইয়াই উহাতে বিশ্বাসী হইয়া থাকে । ঐ রূপ পুরুষের দর্শন, স্পৰ্শন ব্যতীত ক্ষণস্থায়ী রূপরসাদিতেই নিবদ্ধদৃষ্টি, মায়াগ্ৰস্ত জীবকুলের মায়াতীত নিত্যানন্দের আভাস লাভ সুদূরপরাহত । আবার, “যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী” — জড় ভাবিতে ভাবিতে লোকে জড় হইয়া যায় এবং সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্ৰীভগবানের চিন্তায় মানব তৎস্বরূপই প্ৰাপ্ত হয় । পাশ্চাত্যভূমির বহুকাল ঐ রূপ আপ্তপুরুষের পবিত্র-সন্দৰ্শনলাভ হয় নাই; তদুপরি জড়ের চিন্তাতেও বহুকালাতীত হইয়াছে । কাজেই ঐ দুৰ্দশা ! তবে ভারতের ধর্মালোক আবার বর্তমান যুগে শ্ৰীভগবানের অপার কৃপায় অসুরমতাবলম্বী পাশ্চাত্যে প্রবেশ করিয়াছে । সেজন্য আশা হয়, আবার পাশ্চাত্য ভারতকে ধর্মগুরুত্বে বরণ করিয়া, ধ্বংসের পথ হইতে প্ৰত্যাবৃত্ত হইবে এবং জগতের যথার্থ কল্যাণে ক্ৰমশঃ নিজশক্তি প্ৰয়োগ করিতে শিখিবে ।

দেববলে বলীয়ান্‌ ভারত চিরকাল ধর্মসাক্ষাৎকার করিতেই নিজ শক্তি প্রয়োগ করিয়াছে । ঐ চেষ্টা বা সাধনফলেই পূর্বোক্ত ধর্মবিশ্বাস সমূহের সত্যতা সম্বন্ধে সে সাক্ষাৎ প্ৰমাণ পাইয়াছে । ভারত দেখিয়াছে - সত্যই প্রতীকোপাসনা ও বিশ্বাসসহায়ে এই বহুকালগত সংসার-স্বপ্ন একদিন ভাঙ্গিয়া যায়; সত্যই সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসরের অন্ধকারময় গৃহ ঈশ্বরকৃপায় এক মুহুর্তে আলোক পূর্ণ হয় ! ভারত দেখিয়াছে — সত্যই, শ্ৰীভগবান পূর্ণচিদানন্দস্বরূপে সকলের হৃদ্দেশে জ্বলন্তভাবে বিদ্যমান থাকিয়া সকলকে ফিরাইতেছেন, ঘুরাইতেছেন, উদ্দেশ্যবিশেষে চালিত করিতেছেন -
“ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ৷
ভ্রাময়ন্‌ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ৷৷ – [গীতা]
সত্যই, কেবল তাঁহার শরণাপন্ন হইলে পূর্ণ শান্তি লাভ - “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায় !” - নতুবা আর অন্য উপায় নাই ।

যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকাবলম্বনে শ্ৰীভগবচ্ছক্তি মানবনয়নে প্ৰকাশিতা হইয়াছেন । বৈদিক যুগের তেত্রিশটি দেবপ্রতীক এইরূপে পৌরাণিক যুগে তিন শত তেত্ৰিশ কোটী দেবপ্রতীকে পরিণত । তাই বলিয়া কেহ না অনুমান করেন - ঐ তিন শত তেত্ৰিশ কোটী দেবকুলের প্রত্যেকেই এক সময়ে সমভাবে মানবমনে আপনি আপন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল । ধৰ্মেতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায় - ভিন্ন ভিন্ন কালে ভিন্ন ভিন্ন দেবপ্ৰতীকোপাসনা প্ৰবর্তিত হইয়া, ভারতে পূজালাভ করিয়া, মানবের ধর্মলাভের সহায়ক হইয়াছিল । মন্ত্রশাস্ত্ৰাদি পাঠে ঐরূপ কত দেবতার নাম মাত্র কেবল প্ৰাপ্ত হওয়া যায় । তাঁহাদের ধ্যান এবং পূজাপদ্ধতিসকল বর্তমানে লোপ পাইয়াছে । তিব্বত, চীন, জাপানাদি প্রদেশে ঐ সকল দেবতার পূজা প্রচার এখনও দেখিতে পাওয়া যায় ! ভারতের ধর্মপ্রচারক যে, বহু প্ৰাচীন যুগে ঐ সকল দেবপূজা ভারত হইতে উক্ত প্ৰদেশসকলে লইয়া গিয়াছিল, তাহাও বেশ বুঝিতে পারা যায় ।

বৌদ্ধযুগে শতদলে আসীন উজ্জল বুদ্ধমূর্তিই প্রতীকরূপে উত্তর ভারতের অনেক স্থলে অবলম্বিত হয় । ক্রমে উহাই শতদল মধ্যবর্তী উজ্জ্বলালোকে বা পদ্মান্তৰ্গত উজ্জ্বলকিরণবর্ষী মণিখণ্ডে পরিণত হয় । তিব্বতে এবং অন্যান্য বৌদ্ধদেশে এখনও উহাই যে, সাধকের ধ্যানাবলম্বন, তাহা “ওঁ মণিপদ্মে হু” ইত্যাদি মন্ত্রেই স্পষ্ট ব্যক্ত ।

বহির্জগতের পদার্থনিচয়ের ন্যায় শরীরাভ্যন্তরীণ নানা পদার্থও প্রতীকরূপে কালে অবলম্বিত হইয়াছিল । তাহার কতকগুলি এখনও বর্তমান এবং কতকগুলি অধুনা লোপ পাইয়াছে । হৃদয়পুণ্ডরীকের মধ্যাগত উজ্জল আকাশ বা “দহরাকাশ”, নয়নান্তর্বর্তী ছায়া বা ‘ছায়াপুরুষ’ ইত্যাদি ঐরূপে এককালে প্ৰতীকরূপে অবলম্বিত হইয়াছিল - তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের বেদান্তভাষ্যে ঐ সকলের বিশেষ উল্লেখ থাকায়, কালে উহাদের পূজা প্ৰচলন থাকা স্পষ্ট প্ৰতীত হয় ।

ক্ষিতি, অপ্‌, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম — এই ভূতপঞ্চের প্রত্যেকটি এবং অন্ন, প্ৰাণ, মন প্ৰভৃতিও যে কালে সূক্ষ্মদৰ্শী মানব কর্তৃক ব্ৰহ্মপ্ৰতীকরূপে অবলম্বিত ও উপাসিত হয় - এ বিষয়ের প্রমাণও উপনিষৎনিবদ্ধ “কং ব্রহ্মেত্যুপাসীত” - “খং ব্ৰহ্ম” - “অন্নং ব্ৰহ্ম” - ইত্যাদি বহুবিধ বচনাবলীতে উপলব্ধি হয় । শব্দপ্রতীক সুক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতরভাবে আলোচিত হইয়া ক্ৰমে মাণ্ডূক্যোপনিষৎ নিবদ্ধ গভীর প্ৰণবতত্ত্ব এবং নাদব্ৰহ্মবাদে পর্যবসিত হয় - তাহাও এ স্থলে উল্লেখযোগ্য । ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সহিত মনোগত পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাবের নিগুঢ় নিত্য সম্বন্ধ আলোচনা করিয়াই কালে ঐ বাদের উৎপত্তি হয়, এবং ক্রমে উহা বিশাল কায়া ধারণ করিয়া নাদ বা শব্দ হইতে জগদ্যুৎপত্তি নির্ধারিত করে ।

বাহ্যান্তরভেদে, কত প্রতীকের যে এইরূপে কালে কালে উদয় হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা হওয়া সুকঠিন । ঐ সমস্ত প্রতীকের অবলম্বনে যে যে শক্তি-প্ৰকাশ মানব অনুভব করিত, এক মহান্‌ ঈশ্বরবিশ্বাসে উপনীত হইয়া, কালে সে সকলকে তাঁহারই বিভূতিরূপে গণনা করিতে শিখিল । গীতার দশমাধ্যায়ে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ যে যে পদার্থে যে যে ভগবদ্‌বিভূতি দর্শনের উপদেশ অর্জুনকে করিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকটিই প্ৰাচীনকালে পৃথক্‌ পূজা পাইয়াছিল বলিয়া অনুমিত হয় ।

এইরূপে খণ্ড খণ্ড বাহ্য প্ৰতীক সমুদয় একত্রীভূত হইয়া, এক বিরাট্‌ দেবতনুতে এবং খণ্ড খণ্ড আন্তর প্রতীকসমূহ সমষ্টিভূত হইয়া এক মহান্‌ আন্তর প্রতীকে কালে পর্যবসিত হইল - মানব, বিশ্ব-বিরাট্‌ এবং কুলকুণ্ডলিনী শক্তির উপাসনা করিতে শিখিল । তত্তদালোচনা আমাদের অন্য সময়ে করিবার ইচ্ছা রহিল ।

_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

শক্তিপ্রতীক-১ (Power-worship : Shakti Symbol-1)


4.1) শক্তিপ্রতীক : অবতার, গুরু, সিদ্ধপুরুষ, মন্ত্রদাতা, উপগুরু ও শিক্ষক

(Power-symbols : Avatar, Guru, Yogi, Mantra-giver, sub-Guru & Teacher) 

শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিতেন, “গাছ পাথর নিয়ে ভগবানের বিশেষ লীলার প্রকাশ নয়, কিন্তু মানুষের মনই তাঁর বিশেষ লীলার স্থান ।” আবার বলিতেন -“যদি মানুষ না থাক্‌ত, ভক্ত না থাক্‌ত ত ভগবানকে পুঁছত কে – জান্‌ত কে - তাঁর অপার শক্তি, মহিমার কথা বেদবেদান্ত লিখে প্রচার করত কে ? ভক্ত আছে, তাই ভগবান আছে ।” আবার বলিতেন – “ভাগবত, ভক্ত, ভগবান - তিনে এক, একে তিন ।”

বিশেষ শক্তিমৎ পদার্থনিচয় বা শক্তিপ্রতীকসমূহের আলোচনায় প্ৰবৃত্ত হইয়া আমরা প্রথমেই মানবো শক্তিপূজার বা গুরুপূজার অবতারণা করিয়াছি । ইহাতে কেহ যেন না অনুমান করেন যে, মানবের ভিতয়েই বুঝি মানব প্রথম বিশেষ শক্তির পরিচয় পাইয়া তদুপাসনায় নিযুক্ত হয় — গুরুপূজাই বুঝি সে সর্বাগ্রে করিতে শিখিয়া ছিল । মানবপ্রকৃতির ইতিহাস বলে - আমরা অত সহজে সরল পথে চলি না; অতি সন্নিকট পদার্থই আমাদের অতিদূরে বর্তমান; নিজের ঘর না সামলাইয়া - আগেই পরের ঘর সামলাইতে অগ্রসর হওয়া আমাদের স্বতঃসিদ্ধ জাতীয় স্বভাব ! নতুবা যথার্থ জ্ঞান ও সভ্যতা এতদিন জগতে অনেক দূর অগ্রসর হইত !

মানবে প্রকাশ্যভাবে শক্তিপূজা জগৎ অল্পকালই করিতে শিখিয়াছে । ভারতেই ঐ পূজার প্রথম অভ্যুদয় এবং ভারত হইতেই জগতে ঐ পূজার প্রথম প্রচার । স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন “ভারত হইতেই প্ৰবল ধর্মতরঙ্গ কালে কালে উত্থিত হইয়া জগতের সর্বত্র প্রসারিত হইয়াছে এবং পরেও চিরকাল হইতে থাকিবে ।” বৈদিক যুগ হইতেই উহার আভাস পাওয়া যায়; বৌদ্ধযুগের কথা ত নিঃসন্দেহ প্রমাণিত, এবং বর্তমান যুগের বেদান্ত প্রচার আবার, আমাদের চক্ষুসমক্ষেই অভিনীত ! ইতিহাস যেখানেই কালের অন্ধকার ভেদে সমর্থ হইয়াছে এবং হইতেছে, সেখানেই স্বামিজীর ঐ কথা প্ৰমাণিত হইতেছে ।

ভারতেই গুরুরূপী ঐশী শক্তির মানবে প্ৰথম বিকাশ । - ব্ৰহ্মজ্ঞ বৈদিক ঋষিকূলই তাহার প্রমাণ । অবতাররূপী মহাশক্তিকেন্দ্ৰ ভারতেই প্রথম উদিত হইয়া জগতে মহাবিপ্লব আনয়ন এবং সভ্যতা ও জ্ঞানালোক বিকিরণ করিয়াছিল – ভগবান্‌ বুদ্ধ ও তাঁহার পরবর্তী প্রচারকগণের কার্যেই উহা প্রমাণিত । নাগার্জুন প্ৰভৃতি বৌদ্ধ প্রচারকগণের তাতার, চীনজাপানাধিকার - মহারাজ ধর্মাশোকের ইজিপ্ট, আসিয়া-মাইনর, পারস্য প্ৰভৃতি দেশে প্রচারক প্রেরণ এবং এখনও বিদ্যমান শাসনস্তম্ভরাজির কথা স্মরণ কর । বহুকালাভ্যস্ত শ্ৰীগুরুর পূজা এখন ভারতের মজ্জাগত প্ৰাণ ।

অবতার, আধ্যাত্মিক রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট্‌, সর্বদেশের সর্বকালের লোকগুরু, কালে কালে অনেক হইলে ও একই ব্যক্তি, কখনও গুপ্ত কখনও ব্যক্তভাবে উদিত হইয়া চিরকাল জনকল্যাণে রত !

ঐশী সম্পূর্ণতা এবং মানুষী দুর্বলতার অপরূপ মিলনভূমি — তাঁহার শরীর ও মন । স্থূলবুদ্ধি মানবমনে বিপরীত ধর্মভাবের সামঞ্জস্য করিতে যাইয়া পুরাণকার হরিহর, অর্ধনারীশ্বরাদি অপূর্ব দেবমূর্তিসকলের কল্পনা করিয়াছেন - বিপরীত ধর্মশীল অপূর্ব অবতারবিগ্ৰহই কি তাঁহার সে কল্পনার মূলে ?
“অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্‌ ৷
পরং ভাবমজানন্তে মম ভূতমহেশ্বরম ॥ - [গীতা]
অবতাররূপী গুরুকে সম্যক জানিতে ও চিনিতে কে সমর্থ ? তিনি সৰ্বকালেই পরমাত্মার ন্যায় “যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ” - যাহার নিকটে ইচ্ছা, কৃপায় স্বস্বরূপ প্ৰকাশ করিয়া থাকেন ! তাঁহার স্বরূপ লক্ষণ তাঁহারই প্ৰমুখাৎ শুনিয়া শ্রুতি-স্মৃত্যাদি ধর্মশাস্ত্ৰ যতটুকু লিপিবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহারই সংক্ষেপ মর্ম আমরা নিম্নে প্ৰদান করিয়া জগদগুরু অবতারপুরুষে শক্তিপূজার কথা সমাপন করিব ।

১) কে তিনি, পূর্বে কি ছিলেন, এ জন্মে মনুষ্যশরীর পরিগ্ৰহ করিয়া তাঁহার আগমনকারণই বা কি ? - ইত্যাদি জ্ঞানের স্ফূর্তি অবতারপুরুষে আশৈশব অল্পাধিক বর্তমান থাকে । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণে ঐ জ্ঞানের সর্বাপেক্ষা সমধিক বিকাশ ছিল, - একথা ভারতের ধৰ্মেতিহাস-প্ৰসিদ্ধ ।

২) অভাব বোধই আমাদের যাবতীয় চেষ্টার মূলে এবং তদভাব পূরণ না হইলেই দুঃখ । নিজের অভাব বোধ না থাকায়, অপরের অভাব বোধ হইতে অথবা অপরের অভাব বিশেষ দূর করিতেই অবতারপুরুষে সমস্ত চেষ্টার আবির্ভাব হয় । সে একাঙ্গী চেষ্টার অমিতবেগ পুরুষ সাধারণের অভাববোধপ্ৰসুত চেষ্টাতেও কদাপি লক্ষিত হয় না । আজীবন নিঃস্বাৰ্থ চেষ্টা করিতে একমাত্র তাহারাই সমর্থ ।

৩) মনোরাজ্যে তাঁহাদের একাধিপত্য । আপন মনের উপর যদ্রূপ, অপরের মনের উপরেও তদ্রূপ । অপরের মনের কর্মসঞ্চিত পূর্বসংস্কারসমূহ চূৰ্ণ বিচূর্ণ করিয়া স্বল্পকালেই নূতনভাবে নূতনাদর্শে গড়িতে তাঁহারাই সমর্থ । শরীরস্পর্শমাত্রেই অপরের মনে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করিয়া সমাধিস্থ করা বা ভাববিশেষ উপলব্ধি করানর কথা তাঁহাদের সম্বন্ধে সর্ব জাতির ধৰ্মেতিহাসেই বিদ্যমান ।

৪) পরমাত্মার প্রত্যক্ষীকরণের নূতন পথবিশেষ আবিষ্কার করা, অথবা জনসমাজে পূর্ববিদিত পথ বা ধর্মসমূহের ভিতর নূতন সম্বন্ধসুত্ৰাবিষ্কার করা এবং ঐ ভাবের নূতনাদর্শ নিজ জীবনে প্ৰদৰ্শন করিয়া জনসমাজে প্ৰবর্তিত করা তাঁহারাই সনাতনকাল হইতে করিয়া আসিতেছেন ।

৫) ধর্মাদর্শ ভিন্ন, অবতারপুরুষের জীবনে তাৎকালিক সমাজের নৈতিকাদর্শও স্বভাবতঃই সম্পূর্ণ পরিস্ফুট থাকে। নৈতিকাদর্শ ধর্মাদর্শ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এবং সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগে যুগে ভিন্নাকার ধারণ করে — এ কথাটি হৃদয়ঙ্গম না করিয়াই আমরা অনেক সময়ে সকল অবতারপুরুষের জীবনই একরূপ নৈতিকাদর্শে গঠিত দেখিবার প্রত্যাশা করিয়া থাকি এবং তাঁহাদের অলোকসামান্য চরিত্র ঐরূপে তুলনায় পাঠ করিতে যাইয়া ভ্রমে পতিত হই ।

৬) অবতার মুক্তকণ্ঠে জনসাধারণকে বলিয়া যান, “মামেব যে প্ৰপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে” - “Come unto Me all ye that labour and are heavy laden, and I will give you rest” [Matthew XI. 28] - “হে ত্রিতাপাবসন্ন জীবগণ, আমাকে আশ্রয় কর, আমি তোমাদের শান্তি দিব” - এবং তিনি যে লোকগুরু, ঈশ্বরাবতার - এ কথা প্ৰাণে প্ৰাণে স্বয়ং অনুভব করেন ও অপরকেও নিজ শক্তিবলে তদ্রূপ অনুভব করাইয়া থাকেন ।

অবতারপুরুষের সময়ে সময়ে গুপ্তভাবে আবির্ভাবের কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি । শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব এ সম্বন্ধে বলিতেন -“যেমন রাজা সেজোগুজে লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্ৰকাশ্যভাবে ঢ্যাঁড়াপিটে নগর দেখ্‌তে বেরোন, আবার কখন ছদ্মবেশে প্রজাদের অবস্থা ও কার্যকলাপ দেখবার জন্য বেরোন এবং যেই প্ৰজারা টের পেয়ে কানাকানি করতে থাকে - ‘ইনিই রাজা - ছদ্মবেশে আমাদের ভিতর এসেছেন” - অমনি সেখান হতে পালান্‌, সেইরূপ অবতারের ব্যক্ত এবং গুপ্ত আবির্ভাব জান্‌বি ।”

শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব আর একটি কথা অবতার সম্বন্ধে বলিতেন - যথা “অবতারপুরুষের কোনকালে মুক্তি নাই ।” “যেমন সরকারি লোক, জমিদারীর যেখানে গোলযোগ উপস্থিত হবে সেখানেই তাকে তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে হবে এবং গোল থামাতে হবে, সেইরূপ ব্ৰহ্মময়ীর জমীদারীর (জগতের) যেখানেই গোল উপস্থিত হবে, সেখানেই অবতারপুরুষকে আবিভূর্ত হয়ে লোকের দুঃখ মোচন করতে হবে ।” এ কথায় কেহ যেন না অনুমান করেন যে, তবে বুঝি অবতারপুরুষকে চিরকালই মায়াধীন থাকিতে হয় । তিনি স্বভাবতঃই মায়াধীশ, আত্মারাম - কোন কালেই বদ্ধ হন না; অতএব তাঁহার মুক্তি কখন, কিরূপেই বা হইবে !

অবতারই আধ্যাত্মিক জগতে একমাত্র পথপ্রদর্শক । তাঁহাদের পবিত্র চরিত্রের পূজা জগৎ আবহমান কাল হইতে অবনতমস্তকে করিয়া আসিতেছে এবং চিরকালই করিবে । তাঁহাদের মনুষ্যশরীরপরিগ্রহে সমগ্ৰ মানবকুল ধন্য হইয়াছে । হে ভারত ! যুগে যুগে তুমিই তাঁহার বিশেষ কৃপাপাত্র হইয়া ধর্মজগতে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছ । তাঁহার সম্মান ও পূজা করিতে কখনও ভুলিও না ।

ঈশ্বরাবতারের পূজা ভিন্ন আধ্যাত্মিক জগতে ভারত সিদ্ধপুরুষ, মন্ত্রদাতা কুলগুরু, এবং উপগুরু প্ৰভৃতিরও চিরকাল সম্মান এবং পূজা করিয়া আসিতেছে । ইহাদের সম্বন্ধেও এখানে দুই চারিটি কথা বলা যাইতে পারে ।

সিদ্ধপুরুষ ঈশ্বরাবতার নির্দিষ্ট পথবিশেষে অগ্রসর হইয়া পূৰ্ণকাম ও জীবন্মুক্ত হন । ঐকালে তাঁহাতেও আর স্বার্থচেষ্টা অসম্ভব হইয়া উঠে, কারণ যথার্থ ধর্মানন্দলাভে তাঁহার
“যং লব্ধ চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ৷
যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ৷৷” - [গীতা]
— ঐ প্রকার অবস্থা লাভ হইয়া পৃথিবীর যাবতীয় সুখদুঃখাদি অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইয়া যায় । অবতারপুরুষের ন্যায় শক্তির প্ৰকাশ না হইলেও, তাঁহাতে গুরুশক্তি প্ৰবুদ্ধ হইয়া নিয়ত লোককল্যাণে নিযুক্তা থাকেন । ধর্মজগতে নূতন পথাবিষ্কারে সমর্থ না হইলেও তাঁহার দর্শনে কামকাঞ্চনৈকদৃষ্টি স্থুলদর্শী মানব ছায়াপ্রতিম ধর্মাদর্শকে সচল, জীবন্ত বলিয়া অনুভব করিতে থাকে । ঈশ্বরাবতারের ন্যায় স্পর্শ বা ইচ্ছামাত্ৰেই ধর্মজীবন দানে সমর্থ না হইলেও, তাঁহাদের অপরের ধর্মজীবন উদ্দীপিত করিবার ইচ্ছা নিষ্ফল হয় না; এবং জাতিবিশেষের জীবনে এবং তন্মধ্য দিয়া অন্যান্য জাতির জীবনে উত্তাল তরঙ্গমালাসঙ্কুল ধর্মবন্যা খরস্রোতে প্ৰবাহিত করিয়া অবতারপুরুষের ন্যায় অপূর্ব পরিবর্তন সংসাধিত করিতে না পারিলেও, তাঁহারা আপন চতুষ্পার্শ্বস্থ জনসাধারণের মনে ধর্মস্রোত প্ৰবাহিত করিয়া ধন্য করিয়া থাকেন । সিদ্ধাত্মা মন্ত্রাদি অবলম্বনে অপরে ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করিয়া থাকেন । অবতারের কথা ছাড়িয়া দিলে, ইহাদের ন্যায় অপর কোন মানবেই ধর্মশক্তি সমধিক বিকশিত দেখা যায় না । অবতার ধর্মপ্ৰবর্তক; সিদ্ধাত্মা তৎপ্ৰবর্তিত ধৰ্মে জীবন গঠন করিয়া সেই ধর্মকে পুষ্ট রাখেন । ইঁহাদের পূজা করিলে, ইঁহাদের আদর্শে জীবন গঠন করিলে যে মানব ধন্য ও কৃতাৰ্থ হইবে, এ সম্বন্ধে অধিক বলা নিম্প্রয়োজন ।

স্থুল চক্ষুর গোচর না হইলেও ধর্ম জীবন্ত শক্তি ! অনুষ্ঠানে উহার ফল প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিতে এবং অপরকেও অনুভব করাইতে পারা যায় । বিশেষ শক্তিসম্পন্ন পুরুষ আপন শরীরমন হইতে ঐ শক্তি অপরে সঞ্চারিত করিতে পারেন এবং ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোকসম্বন্ধীয় যে সকল অনুভব জীবনে প্ৰতক্ষ্য করা তাহার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, সে সকলও অপরকে সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষ করাইতে পারেন । - বহুকাল হইতে এসকল কথা প্ৰত্যক্ষ করিয়া ভারত বিশ্বাস করিয়া আসিতেছে ।

আবার বহুকালব্যাপী চেষ্টা, ধ্যান ও একাগ্রতার দ্বারা ভাববিশেষ উপলব্ধি করিয়া, তাহাকে শব্দবিশেষের সহিত এমন সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করা যাইতে পারে যে, উহার উচ্চারণমাত্রেই ঐ ভাববিশেষ উজ্জ্বল বর্ণে অপরের মনে উদিত হইয়া তাহাকে অপূর্ব অনুভব প্ৰত্যক্ষ করাইবে; এবং প্রত্যেক অনুভব যেমন ফলস্বরূপ আনন্দ বা দুঃখ প্রসব করিয়া মানবজীবন পরিবর্তিত করে, ঐ বিচিত্রানুভবেও তদ্রূপ তাহার মন বিশেষরূপে পরিবর্তিত হইয়া বিশেষ আনন্দ বা দুঃখের অধিকারী হইবে । উহারই নাম মন্ত্রশক্তি । ঐ মন্ত্রশক্তির প্রভাবও ভারত বহুকাল হইতে অবগত হইয়া তদারাধনায় নিত্য নিরত আছে । শঠ-ধূর্তের হস্তে সময়ে সময়ে প্ৰতারিত ও ক্ষতিগ্ৰস্ত হইলেও, উপযুক্ত গুরুসহায়ে ভারতে ঐ সকল বিষয়, পুরাকালে এবং অধুনা, বহুবার পরীক্ষিত এবং সত্য বলিয়া নির্ণিত হইয়াছে । মন্ত্রশক্তির উপর বিশ্বাসই মন্ত্রদাতা-গুরূপাসনার মূলে বর্তমান ।

অবতারপুরুষোচ্চারিত বাক্যসকলই যথার্থ মন্ত্র ও আশুফলপ্ৰদ ; কারণ উহাতে তাঁহাদের বিশেষ শক্তি নিহিত থাকে । সহস্ৰ বৎসর বা তদধিক কাল পরেও সে শক্তির স্বল্পাধিক পরিচয় পাওয়া যাইয়া থাকে । সিদ্ধপুরুষোচ্চারিত মন্ত্রও দ্বাদশ বৎসরের মধ্যেই ফল প্ৰত্যক্ষ করায়, ইহা লোক প্ৰসিদ্ধ । সাধুসাধকোচ্চারিত মন্ত্রের ফল উপলব্ধি করিতে তদপেক্ষাও অধিক কাল লাগে ।

মন্ত্রফল উপলব্ধি করিতে কেবল যে উপযুক্ত গুরু আবশ্যক তাহা নহে । “আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠো” ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন উপযুক্ত শিষ্যেই গুরুশক্তি সঞ্চারিত হইলে আশুফল প্ৰত্যক্ষ করাইয়া থাকে । সুফল লাভ করিতে এখানেও - উর্বর জমি, উত্তম কর্ষণ, উত্তম বীজ এবং তদুপরি ঐ বীজের যত্নের সহিত সংরক্ষা এবং জলসেকাদির প্ৰয়োজন । বীজ উত্তম হইলেও যে অনেক সময় মন্ত্রফল প্ৰত্যক্ষ হয় না, তাহার কারণ ঐ সকল প্ৰয়োজনীয় বিষয়গুলির অভাব ভিন্ন আর কিছুই নহে । আমাদের জনৈক শ্ৰদ্ধাস্পদ বন্ধু বলিতেন, “নোঙ্গর ফেলিয়া দাঁড় টানিলে যেমন নৌকা কখন অগ্রসর হয় না, সেইরূপ ঐ সকলের অভাব হইলে ভগবচ্ছক্তি উপলব্ধিরূপ প্ৰত্যাশাও বিফল হয় ।”

মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস বিষয়াসক্ত মনের অনেক সময় অপকারেরও কারণ হইয়া থাকে । এক ব্যক্তির মন অপর ব্যক্তির মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে জানিয়া কামক্রোধান্ধ পুরুষ অনেক সময়ে নিজ স্বাৰ্থতৃপ্তির আশয়ে ঐ শক্তির আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়া থাকে । অথবা দুৰ্বল নীচচেতা পশুবৃত্তি মানব, আপন পাশব-প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য, পবিত্র গুরুনামের অযোগ্য, অপর নীচতর পুরুষের সহায়ে ঐ শক্তি প্ৰয়োগ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে । বলা বাহুল্য যে, ঐরূপ চেষ্টা কদাচিৎ সফল হইলেও ঐ দুর্বৃত্তেরাই পরিণামে নানাবিধ দুঃখ অশান্তি এবং মানসিক অবনতিরূপ দণ্ড ভোগ করিয়া থাকে । তন্ত্রশাস্ত্রের অনেক স্থলে পবিত্ৰ ঐশী শক্তি আরাধনার বিশেষ বিধানের সঙ্গে সঙ্গে মারণ, উচাটন, বশীকরণাদির বিশেষ ব্যবস্থা দেখিয়া মনে হয়, পাশবপ্রকৃতি মানব উহা পরে বিশুদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের সহিত সংযুক্ত করিয়া ধৰ্মের নামে প্ৰবৃত্তির পৈশাচিক অভিনয় দেখাইয়া কলঙ্কিত করিয়াছে । বৌদ্ধধৰ্মের অধঃপতনকালে ভারতে যে ঐ প্রকার দুর্বৃত্তের সংখ্যা অধিক হইয়াছিল তাহাও ইতিহাসপ্রমাণিত । ঐ ধর্মগ্লানি দূর করিবার জন্যই পরে জ্ঞানগুরু শিবাবতার শঙ্করাচার্যের এবং ভক্তিপ্ৰাণ শ্ৰীচৈতন্যের ভারতে উদয় । তাঁহারাই পুনর্বার শক্তি উপাসনার পবিত্ৰাদর্শ জনসাধারণে দেখাইয়া শিবোক্ত তন্ত্রশাস্ত্রের যথার্থ মর্যাদা সংস্থাপন করিয়াছিলেন । শ্ৰীশঙ্করাচার্যলিখিত শিবদুর্গাদি-বিষয়িণী স্তবরাজি ও বিষ্ণুসহস্রনামের ভাষ্য এবং শ্ৰীচৈতন্যের অন্নপূর্ণা দেবীকে আপন ইষ্টরূপে উপাসনাতেই উহা অবগত হওয়া যায় । অন্নপূর্ণা শ্ৰীশঙ্করেরও যে ইষ্টদেবী ছিলেন ইহারও প্ৰমাণ পাওয়া যায় ।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ দেব বলিতেন, “প্রত্যেক অবতারই সযত্নে শক্তির উপাসনা করিয়া গিয়াছেন । শক্তির বিশেষ অনুগ্রহলাভ না করিয়া কখনই লোকগুরুত্ব লাভ করিতে পারা যায় না, অথবা ধর্মভাগীরথীর প্ৰবল তরঙ্গে দেশ আপ্লাবিত করিয়া জনসাধারণে যথার্থ ধর্ম প্রচার করিতে পারা যায় না ।” শ্ৰীচৈতন্যের বেদান্তভাব বা শক্তি উপাসনার কথা শুনা যায় না বলিয়া আপত্তি উত্থাপিত হইলে, শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব আমাদের বলিয়াছিলেন, “যেমন হাতীর দুই প্ৰকার দাঁত থাকে, এক প্রকার বাহিরে, শত্রু আক্রমণ করিবার জন্য, এবং অপর প্রকার ভিতরে, খাইবার জন্য - শ্ৰীচৈতন্যেও সেইরূপ দুইপ্ৰকার ভাব ছিল । ভক্তি তাঁহার বাহিরের ভাব - সাধারণের নিকট প্রচারের জন্য; এবং বেদান্ত ও শক্তি উপাসনা তাঁহার ভিতরের ভাব - উহা নিজের জন্য; কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ এবং অন্নপূর্ণা দেবীর উপাসনাতেই উহা বুঝা যায় ।”

যে শক্তিরই উপাসনা কর, অতি পবিত্রভাবে শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া অগ্রসর হইতে হইবে । স্বাৰ্থানুসন্ধানের নাম গন্ধ পর্যন্ত মন হইতে দূরে রাখিতে হইবে । নতুবা উপাসনায় সিদ্ধিলাভ অসম্ভব এবং অনেক সময়ে বিপরীত ফলেরও উদয় হইয়া উপাসককে অবসন্ন করে । এ কথাটি মনে সর্বদা জাগরূক রাখিয়া অগ্রসর হইতে হইবে । অযথা শক্তি প্ৰয়োগে বা নিজের স্বাৰ্থসুখের জন্য শক্তি, প্ৰয়োগে পরিণামে শক্তি হানি এবং দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হইবে নিশ্চয় । অগ্নি লইয়া খেলা করিতে যাইয়া অনেকে অনেক সময় নিজের গাত্র ও গৃহাদি দগ্ধ করিয়া বসে । স্থূল শক্তিতে উহা যেমন, সূক্ষ্ম শক্তির সহিত খেলাতেও ঠিক তদ্রূপ, বরং অধিক কুফল প্রসব করে । শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সর্বপ্রকার শক্তির প্রয়োগই জানিয়া শুনিয়া শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সাবধানে করিতে হইবে । শারীরিক শক্তির অপব্যয়ে কত লোকেই না অকালবৃদ্ধ হইয়া আক্ষেপভারপীড়িত জীবন বহন করিয়া আপনাকে ও সমাজকে দুৰ্বল করিয়া ফেলে । মানসিক শক্তির অপব্যয়ে কত লোকেই না আবার মেধাশূন্য, অস্থিরমনা ও উন্মাদপ্রায় হইয়া আপনাকে এবং অপরকে অধিকতর ক্ষতিগ্ৰস্ত করে । আবার আধ্যাত্মিক শক্তির অপব্যয়ে কতবার যে ভারত ও ভারতেতর দেশসমূহ পশু, বর্বরতুল্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহাও ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে । হে উপাসক ! এ সকল দৃষ্টান্ত মনে রাখিয়া শ্রদ্ধার সহিত সাবধানে শক্তিপূজায় অগ্রসর হইও ।

মন্ত্রদাতা-গুরূপাসনার কথা প্রসঙ্গে বঙ্গের লৌকিকাচার - কুলগুরু ও গুরুবংশের উপাসনার কথা মনে উদয় হয় । আমরা উহাকে বঙ্গেরই আচারবিশেষ বলিলাম, কারণ, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ঐরূপ আচার আমাদের নয়নগোচর হয় নাই । সেখানে সংসারত্যাগী সাধু বা নিষ্ঠাবান্‌ ধাৰ্মিক গৃহস্থ - যাঁহার উপরেই কোন ব্যক্তির হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভক্তির উদয় হইয়া থাকে, তাঁহারই নিকট হইতে মন্ত্রগ্রহণের রীতি প্রচলিত । সংসারত্যাগী গুরু হইলে তিনি যে, কোন্‌ প্রদেশের কোন্‌ বংশে, জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহার ঠিকানাই অনেক সময়ে পাওয়া যায় না । কাজেই গুরুকুলের উপাসনা অসম্ভব হইয়া পড়ে; এবং ধাৰ্মিক গৃহস্থ গুরু হইলে, তাঁহার জীবৎকাল পর্যন্ত বা তাঁহার শরীরত্যাগের কিছু পর পর্যন্ত শিষ্যের ভক্তি ঐ বংশের উপর প্রবাহিত থাকে, এই পর্যন্ত । কিন্তু গুরুর পুত্ৰ উপযুক্ত হউন বা নাই হউন এবং শিষ্যপুত্রের তাঁহার উপর শ্রদ্ধার উদয় হউক বা নাই হউক, তাঁহার নিকট হইতেই মন্ত্র গ্ৰহণ করিয়া তাঁহাকে ঈশ্বর লাভের সহায়রূপে গ্ৰহণ করিতে হইবে - এ প্রথার প্রচলন নাই ।

বঙ্গে সংসারত্যাগী সাধুর সংখ্যা অল্প হওয়াতে এবং পিতার গুণ সন্তানে উপগত হয় - এই বিশ্বাস থাকাতে, ঐরূপ প্ৰথা প্ৰচলিত বলিয়া বোধ হয় । শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যাবির্ভাবের পূর্বে ভদ্র বংশীয়দের সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণের কথা প্ৰায় শ্ৰবণগোচরই হইত না । বিরল কেহ কেহ উত্তরপশ্চিম-প্ৰদেশাগত কোন কোন সাধুসন্ন্যাসীর ভাবে মুগ্ধ হইয়া ঐ পথ অবলম্বন করিলেও প্ৰায় জন্মের মত দেশত্যাগ করিয়া যাইত । কাজেই তাহাদের দ্বারা বঙ্গে আর ঐ সম্প্রদায় বৃদ্ধি পাইত না । আবার বঙ্গে তন্ত্রমতের সমধিক প্ৰচলন থাকাতে এবং ঐ মতে সস্ত্রীক ধর্মোপাসনায় আশু ভগবৎকৃপা লাভ হয় প্রচার থাকাতে, নিষ্ঠাবান্‌ উদারমনা গৃহস্থকে গুরুরূপে বরণ করার প্রথাই প্ৰচলিত হয় ।

বঙ্গের ঐ আচার এখন অনেকাংশে দূষণীয় হইলেও যতদিন না গুরুকুলের শিষ্যব্যবসায়বৃত্তি বা তদ্বারাই জীবিকানিৰ্বাহ করা রূপ কুপ্রথার প্রচলন হয়, ততদিন পর্যন্ত এ প্রদেশের অনেক কল্যাণ সাধন করিয়াছে । উহা গুরুবংশের সন্তানগণের ভিতর গুরুনামের উপযুক্ত হইবার বাসনা প্ৰবল রাখিয়া বিদ্যা ও সদাচার পুষ্ট রাখিয়াছিল । আবার সমাজে এক শ্রেণী অনেকটা নিশ্চিন্তমনে কেবল ধর্মচৰ্চাতে নিযুক্ত থাকায় ধর্মাদর্শও তাঁহাদের ভিতর উজ্জ্বল থাকিয়া লোককল্যাণ সাধন করিত । ঔপনিষদিক সময়ে ঋষিকুল গৃহস্থ হইলেও ঐরূপ অবসর লাভে ধর্মচর্চায় নিযুক্ত থাকিয়া সমগ্ৰ দেশ এবং জাতির যে কত কল্যাণ সাধন করিয়াছিলেন, তাহা সর্বজনবিদিত ।

পূর্বে বঙ্গে অন্নও সুপ্ৰতুল ছিল । মুসলমান রাজাধিকারেও সময়ে সময়ে টাকায় আট মণ চাউলের কথা ইতিহাস প্ৰসিদ্ধ । এখন অন্ন পর্যাপ্ত জন্মিলেও বাষ্পীয় শকটের কৃপায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং বাষ্পীয় পোতবাহনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানির প্ৰবল স্রোতে বঙ্গের অন্ন অন্যত্ৰ নীত হয় । তদুপরি বিলাতি সভ্যতার মহার্ঘতা, বিদ্যাশিক্ষার বিপরীত ব্যয় প্রভৃতি নানা কারণে গুরু এবং শিষ্য উভয়েই ব্যতিব্যস্ত । উভয়কেই নানা উপায়ে কথঞ্চিৎ জীবিকানিৰ্বাহ করিতে হইতেছে । পরিশ্রম না করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া জীবিকানিৰ্বাহ গুরুকুলের বহুকালাভ্যস্ত । সেজন্য তাঁহারাই সমধিক বিপদে পতিত হইয়াছেন; এবং মিথ্যাভাষণ, চাটুকারিতা প্রভৃতি নীচ উপায় সমূহ অবলম্বন করিয়া শিষ্যবর্গের মনোরঞ্জন দ্বারা অর্থসংগ্রহে মনোনিবেশ করিয়া, তাঁহাদের অনেকেই এককালে ধর্মতেজোবিহীন হইয়া হতশ্ৰী ও ইতর হইয়া পড়িয়াছেন । উপযুক্ত গুরুর অভাবে শিষ্যের ভক্তিও হ্রাস পাইয়াছে । এখন এ প্রথার উচ্ছেদ অনিবাৰ্য এবং উচ্ছেদ হইলেও দেশের অকল্যাণ বলিয়া বোধ হয় না ।

আবার দেখা যায়, অবতার অথবা বিশেষ শক্তিসম্পন্ন ধর্মাত্মা মহাপুরুষ যে বংশ পবিত্র করেন, তাহার প্রায়শঃ লোপ হইয়া থাকে; অথবা সে বংশে আর সেরূপ শক্তিমান পুরুষের আবির্ভাব দেখিতে পাওয়া যায় না । স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, “Genius বা বিশেষ শক্তিমান পুরুষ কোনও বংশে জন্মিবার কালে ঐ বংশের পূৰ্বাপর যাবতীয় শক্তি যেমন নিঃশেষে আকৰ্ষিত হইয়া তাঁহাতে সমাবিষ্ট এবং প্ৰকাশিত হয় । সে জন্যই তাঁহার জন্মের পর ঐ বংশে বাতুল, শ্ৰীহীন বা অতি সাধারণ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণই জন্মগ্রহণ করে এবং ক্রমে ঐ বংশের অনেক স্থলে লোপও হইয়া যায় ।” সেইজন্য অবতার বা সিদ্ধপুরুষ যে বংশ পবিত্র করিয়া থাকেন, তাহার উপর স্বতঃই লোকের শ্রদ্ধা ভক্তি প্রবাহিত হইলেও উহাতে ধর্মশক্তির প্রকাশ সৰ্বকাল স্থির থাকে না । উহাও বোধ হয় শিষ্য কুলের গুরুকুলের উপর ক্রমশঃ ভক্তিহীনতার অন্যতম কারণ ।

মন্ত্রদাতা গুরু একজন হইলেও শিষ্য তাঁহার নিকট যাহা শিক্ষিতব্য শিক্ষা ও নিজ জীবনে সাধন করিয়া ধর্মবিষয়িণী অপর শিক্ষাসমূহ অপর গুরুর নিকটে যে সম্পূর্ণ করিতে পারে, ইহা বেদাদি সৰ্বশান্ত্রের বিধান । যাঁহারা ঐ রূপ শিক্ষার সহায়তা করেন, তাঁহারাই উপগুরু নামে প্ৰসিদ্ধ ।

আধ্যাত্মিক জগতে গুরূপাসনা ভিন্ন ভারতে ব্যবহারিক অপরা বিদ্যা - যথা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যাদি - বা অর্থকরী বিদ্যার শিক্ষয়িতারও বিশেষ সম্মান এবং পূজাবিধান আছে । বর্তমানকালে উহার বিশেষ অভাব লক্ষিত হইয়া থাকে । উহাতে গুরু এবং শিষ্য অথবা শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়েরই দোষ বর্তমান বলিয়া বোধ হয় । শিক্ষক ছাত্ৰাদিগকে নিজ তনয়ের ন্যায় ভালবাসা ও স্নেহের চক্ষে দর্শন করেন না, ছাত্রেরাও শিক্ষককে পিতার ন্যায় ভক্তি ভালবাসা প্ৰদৰ্শন করে না । স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন, “শ্রদ্ধাহীনতাই আমাদের শিক্ষাজগতে সর্বনাশ সাধন করিতেছে এবং শ্রদ্ধার অভাবেই আমাদের বালকদিগের যথাৰ্থ শিক্ষালাভ হইতেছে না ।” ছাত্র ও শিক্ষকের ভিতর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্বন্ধ থাকতে এবং বিদ্যা যে কেবল অর্থোপার্জনের জন্য নহে - জ্ঞানলাভের জন্য, এই ভাব বর্তমান থাকাতেই ইউরোপে অধুনা বিদ্যার এত উন্নতি হইয়াছে । শিক্ষাকালে গুরুর সহিত একত্ৰ বাসের এবং তাঁহার প্রত্যেক কার্য দেখিয়া তাঁহার প্রতি যাহাতে ভক্তি উদয় হয়, সে সকল বন্দোবস্তের অভাবই ঐ প্রকার শ্রদ্ধাহীনতার কারণ বলিয়া বোধ হয় । পুরাকালে ব্ৰহ্মচারী ছাত্ৰগণ গুরুকুলে বাস করিয়া যে কতদূর যথার্থ শিক্ষালাভ করিত, তাহা পুরাণেতিহাস পাঠে জানিতে পারা যায় ।

মানবে গুরুরূপিণী ঐশী শক্তি আবিভূর্তা হইয়া মানবজাতির পরম কল্যাণসাধনে যে প্ৰবৃত্ত হন, অথবা বর্বর, বন্য মানবকে সমাজ, নীতি, বিদ্যা, ধর্মাদি আলোক-দানে দেবতা করিয়া তুলেন - একথার পরিচয় ভারত যেদিন হইতে পাইয়াছে, সেই দিন হইতেই বুঝিয়াছে, গুরু মনুষ্য নহেন - গুরু নরশরীরে ঐশী বিকাশ ! সে দিন হইতেই “গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ” প্রভৃতি মন্ত্রের প্রচার । সেই সময় হইতেই প্রচার -
“যস্য দেবে পরা "ভক্তিৰ্যথা দেবে তথা গুরৌ ৷
তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্ৰকাশন্তে মহাত্মনঃ ৷৷” - [শ্বেতাশ্বতর ]
গুরুতে মনুষ্যবুদ্ধি করিলে কখনও জ্ঞানলাভ হয় না । হে ভারত ! শ্ৰীগুরুর মূর্তিতে শক্তিপূজা করিতে যতদিন তুমি না ভূলিবে ততদিন পৃথিবীতে এমন কে আছে যে তোমার জাতীয় জীবন বা শক্তির লোপ করিতে পারে ? গুরুবলে বলীয়ান ! গুরুরূপী ধ্রুবতারানিবদ্ধদৃষ্টি হইয়া গন্তব্যপথে অগ্রসর হও !

আর তুমি, হে নিত্যমুক্ত আত্মারাম গুরো ! - তুমি আমাদের জ্ঞানচক্ষু সম্যক্‌ প্ৰস্ফুটিত কর ! তোমাকে বার বার প্রণাম করি ! তোমার কৃপায় প্রত্যেক ভারত-ভারতী নবীন আধ্যাত্মিক জীবনের দিব্যভাবের অমিততেজে সম্যক্‌ উদ্ধুদ্ধ হউক এবং শ্রদ্ধাসহকারে তোমার পূজা করিয়া দেশের কল্যাণের জন্য নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ বলিদানে সমর্থ হউক ! হে শ্যামা, গুরুরূপিণি ! পদাশ্ৰিত ভারতে নবযুগে নবশক্তি সঞ্চারিত কর ! যাহাতে তোমার শ্ৰীমূর্তির জীবন্ত পূজা প্রচারে সে চিরকৃতাৰ্থ হইতে পারে, অপরকেও তদ্রূপ করিতে পারে ।


_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>