Thursday, April 20, 2017

অবতারতত্ত্ব ও গুরুপ্রতীক (Power-worship : Avatar & Guru)


3) অবতারতত্ত্ব ও গুরুপ্রতীক


উপরে – অনন্তকোটীব্রহ্মাণ্ডাতিসমাচ্ছন্ন শ্যামল আকাশ; নীচে – শস্য-শ্যামলা বসুন্ধরাবক্ষে শ্যামল অচলমালার কৃষ্ণনীরদাবৃত শৃঙ্গাবলী ও তৎপদপ্রান্তে চিরচঞ্চল শ্যামল জলধির বীচিবিক্ষোভময় প্রলয়তাণ্ডব ! হে শ্যামা, বিরাট স্থুল শরীরে তোমার এ স্থুলভাবের খেলা !

বাহিরে – ক্ষুদ্রায়তন, ক্ষণভঙ্গুর, রোগাদির নিত্য আশ্রয়, নিশ্চিতমৃত্যু কিন্তু ?নিশ্চিততৎকাল, নগণ্য মনুষ্যশরীর; ভিতরে – দেশকালব্যবধান-উল্লঙ্ঘন-প্রয়াসী, সর্ববিধরহস্য-ভেদন-তৎপর, হঠকারিতায় জগৎকর্তারও স্বভাব-নিরূপণে অগ্রসর, কাৰ্যমাত্রানুমেয় বিচিত্র লীলা !

সম্মুখে – রূপরসাদির অনন্তহাবভাবযুক্ত অগণনমোহনশ্রী এবং নানা-চিন্তাকার্যসমাকুল, আত্মবিস্মৃত, রহিতাবসর-হিতাহিতদৃষ্টি, উন্মাদ মন ও ইন্দ্রিয়গ্রামের তদালিঙ্গনে উন্মাদচেষ্টা; পশ্চাতে - ইচ্ছামাত্ৰ-সহায়, কেন্দ্রীভূতশক্তি, অচল, অটল, সাক্ষিবৎ, সমাসীন অপরোক্ষ আত্মা । হে মায়ে ! কারণরূপিণি ! তোমার এ সর্বোৎকৃষ্ট অপুর্ব লীলাবিলাস !

আবার, মন-বুদ্ধির অতীত ‘স্তিমিতসলিলরাশি-প্রখ্যমাখ্যাবিহীন’ ‘বিগতভেদাভেদ শমিতসর্বনামরূপ’ তোমার যে অবস্থা, যাহার মহিমা ভারতের ঋষিকুল একপ্রাণে, একবাক্যে বর্ণনায় এবং মানব-সাধারণের বুদ্ধিগ্রাহ্য করিয়া চিরশান্তিদানের চেষ্টায় নিরন্তর ব্যস্ত । হে অম্ব, শক্তিরূপিণি, উহাই কি তোমার নিত্যা মূর্তি ? সাধারণ মানব কি বলিতে পারে ? স্তব্ধীভূতবাসনাজাল, মনবুদ্ধির পারে অবস্থিত, তোমার বরপুত্র, জগদ্‌গুরু, মহাপুরুষ ঈশ্বরাবতারেরাই সেই কথা বলিতে পারেন ।

কতকাল ধরিয়া ভারত তোমার জগদ্‌গুরু-মূর্তির পূজা করিল – কবে ঐ পূজার প্রথমারম্ভ ? তোমার ঐ অতীন্দ্রিয়মূর্তির দর্শনলাভে মানব ঋষিত্ব, দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়া সমগ্র মানবকূল ধন্য করে, এ কথা দেশের জনসাধারণ কবে হৃদয়ঙ্গম করিল ? কে শিখাইল ?

সহস্রারপঙ্কজ তোমার কৃপায় ভারতেই প্রথম সগৌরবে বিকশিত হইল – তৃষিত ভ্রমরকুলও তৎসকাশে আপনি আসিয়া জুটিল এবং মোহিত হইয়া নিজ নিজ মন প্রাণ উৎসর্গ করিল – শ্রীগুরুমূর্তিতে তোমার পূজা জনসাধারণে এই ভাবেই প্রথম করিতে শিখিল !

মানবে শক্তিপূজা – মানবে মনুষ্যত্বের সহিত তোমার অভূতপূর্ব মিলন দেখিয়া হৃদয়ের সরল কোমল পবিত্র ভাবসমূহ তৎপদে ঢালিয়া দেওয়া, তোমার সহিত তাহাকে চিরমিলিত দেখিয়া, তোমার সহিত তাহার একত্ব অনুভব করিয়া, তাহাকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, পরব্রহ্মাদি নামে অভিহিত করা - একটা ঢং করিয়া, দশজনে পরামর্শ করিয়া করা নহে – হৃদয়ের পূর্ণতায়, প্রাণের উল্লাসে, ‘মন মুখ এক’ করিয়া সত্য সত্যই সর্বকাল করা ! – এই রূপেই কি গুরুবাদ ধীরে ধীরে ভারতের অস্থিমজ্জায় প্রবিষ্ট হইল ?

মন-বুদ্ধির পারগত মানবে মন-বুদ্ধি-কল্পনাতীত শক্তির প্রকাশ । ভাবনাতীতভাবে তুমি তথায় প্রকাশিতা । কামকাঞ্চনের খরস্রোতে বিষয়-সমুদ্রাভিমুখে দ্রুত ভাসমান জগতে ঐরূপ মানবই কেবল নিত্যহিমাচল-নিবদ্ধদৃষ্টি, বিপরীতগমনসামর্থ্যবান ! কেনই বা মানবসাধারণ তাঁহার পূজা না করিবে ?

নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বাৰ্থচিন্তামগ্ন আব্রহ্স্তম্বপর্যন্ত প্ৰাণিসমূহের মধ্যে তিনিই কেবল লব্ধকাম হইয়া প্রহিতানুধ্যানমগ্ন । তাহাও আবার কোনরূপ প্ৰত্যাশায় নহে । জগৎ তো কতবার নিজ কল্যাণ না বুঝিয়া তাঁহাদের উপর কত অনাচার অত্যাচার বিসদৃশ ব্যবহার করিয়াছে – ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে । তাঁহারাও অম্লানবদনে অক্ষুণ্ণমনে আশীর্বাণী উচ্চারণ করিতে করিতে বিন্দু বিন্দু রুধিরপাত সহ্য করিয়াছেন-মরিয়াছেন – অস্থিতে অমোঘ বজ্রের সৃজন হইয়া জগতের জনসাধারণেরই রক্ষণ ও কল্যাণ সাধিত হইয়াছে । হে অহেতুকদয়ানিধে গুরো ! তুমি মরিয়াও অমর, সচল, জীবন্ত, ঘনীভূত শক্তি-প্রতিমা; জগৎ কেনই বা তোমার পদে স্বেচ্ছায় লুণ্ঠিত না হইবে । কেনই বা তোমায় ‘গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ’ ইত্যাদি বাক্যে স্তব না করিবে !

ভারত বুঝিয়াছে, গুরু মনুষ্য নহেন; ম্নুষ্যমূর্তিতে বিদ্যারূপিণি তুমি । মহাশক্তি কেন্দ্রীভূত হইয়া আকার ও মূর্তিবিশেষ আশ্রয় করিয়া মানবের শিক্ষার্থে, হিতার্থে, মহদ্ভয়াবিনাশার্থে করুণায় প্রকাশিতা । আর মানুষী মূর্তিতে তোমার ঐরূপে কেন্দ্রীভূত হওয়া ? উহাও তোমার নানা লীলাবিলাসের মধ্যগত এক অপূর্ব লীলা-ভঙ্গ ।

কোথায়, কি নিয়মে ঐ মহাশক্তি কেন্দ্ৰসমূহ সমুদ্ভূত হয়, উহাদের আবিৰ্ভাবসময়ে দেশের পূর্বাপর অবস্থাই বা কিরূপ হইয়া থাকে ?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেন -
“যদা যদা হি ধৰ্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌ ৷৷”
নিদাঘে পুঞ্জীভূত আতপতাপ বায়ুস্তরের তরলতা-সম্পাদন করিয়া এবং সহসা প্রসার আনয়ন করিয়া যেমন হঠাৎ প্ৰবল বাত্যার সৃজন করিয়া থাকে, অজ্ঞান-প্ৰসূত পুঞ্জীভূত অনাচার, অধর্ম, মানবের অন্তর্গতে ঐরূপ আমূল পরিবর্তন আনিয়া মহাশক্তির’ কেন্দ্রীভূত প্রকাশের অবসর করিয়া দেয় । তখন মানুষের মনে ভাবের স্রোত পরিবর্তিত হইয়া তাণ্ডবতরঙ্গে বিপরীত গতিতে ধাবিত হইয়া থাকে । মানবমনের সঙ্কীর্ণ বাঁধসমূহ চূৰ্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়; কোথাও বা ভাবস্রোতে চিরনিমজ্জিত হইয়া জলধিতলগত আটলাণ্টা দ্বীপের ন্যায় অন্ধতমসাবৃত হয় । সেইজন্যই কি মনুষ্যমনের কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণ ভাবরাশির উপর নির্ভর করিয়া যাঁহারা ইহসংসারে গুরু সাজিয়া দোকানপাট খুলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসেন, যথার্থ গুরুরূপী কেন্দ্রীভূত শক্তিবিকাশের সময় যুগে যুগে তাঁহদের মহদ্ভয় আসিয়া উপস্থিত হয় ? জগতের ‘দশকর্মান্বিত’ ব্ৰাহ্মণ, পুরোহিত, শিষ্যব্যবসায়ী গুরুকুল ! সাবধান - আবার বর্তমান যুগে কেন্দ্রীভূত গুরুশক্তি প্ৰকাশিত হইয়া মানবমনের সঙ্কীর্ণতার বাঁধ ভাঙ্গিয়া দিতেছে । নূতন তরঙ্গে দেশ কোথায় কতদূরে ভাসিয়া যাইবে, কে বলিতে পারে ? ধর্মভানী দুনিয়াদার, তোমাদের দুর্দশা কতদূর গড়াইবে, তাহাই বা কে বলিবে ?

মনের ভাবই কাৰ্যপরিণামে স্থুল আকার ধারণ করে । উহা ব্যক্তিতে যেমন, জাতিতেও ঠিক তেমনি । আবার ব্যক্তির সমষ্টি সমাজসকলের আবাসস্থল দেশ, পৃথিবী ও বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেও ঠিক তদ্রূপ ।

যথার্থ গুরুশক্তির উদয়ে নূতন ভাব-প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যসমাজে কতই না পরিবর্তন সমুপস্থিত হয় । তখন পরিবর্তনমুখে অধিষ্ঠিতা থাকিয়া ভয়ঙ্করী ভীমা সর্বত্র পৰ্যটন করেন এবং বহুকাল পৰ্যন্ত সাদরে পোষিত মানবমনের সর্বপ্রকার সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি মথিত ও বিধ্বস্ত করিয়া দেন । তখন বিপরীত ভাবস্রোতে পড়িয়া কর্তব্য লইয়া ভ্ৰাতায় ভ্ৰাতায় একমত হয় না - স্বামী স্ত্রী বিপরীত-মতাবলম্বী - পিতা-পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয় (Matthew. X. 34-36)

অজ্ঞানের সহিত জ্ঞানের সংগ্রাম । যুগে যুগে আবহমানকাল ধরিয়া ব্যক্তির ভিতর, জাতির ভিতর, সমাজের ভিতর, দেশের ভিতর, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড্বের ভিতর, কতভাবে কতরূপে কতই না হইল ও হইতেছে । ইহাই কি শাস্ত্ৰ-কথিত দেবাসুরের দ্বন্দ্ব ? কোনও কালে কি ইহার বিরাম হইবে ? কোনও কালে কি জগৎ সত্য, ন্যায় এবং জ্ঞানকে সম্মুখ রাখিয়া প্ৰত্যেক চিন্তা, বাক্য ও কাৰ্য করিবে ? যাঁহার জগৎ তিনিই বলিতে পারেন । কিন্তু হে ভীরু, এ সংগ্রামে পশ্চাৎপদ হইও না । হইয়াই বা করিবে কি ? ভিতরে বাহিরে যেখানে চাহ, দেখ ঐ সংগ্রাম । আত্মহিত চাও, উহা করিতে হইবে; পরহিত চাও, উহাই; নিশ্চিন্ত হইয়া বিশ্রাম লাভ করিতে চাও, উহা না করিলে যথার্থ বিশ্রামলাভ হইবে না । তবে ওঠ, জাগ, কোমর বাঁধ, শক্তিরূপিণী তোমার সহায় হইবেন ।

অন্য দেশে মা শতহস্তে ধনধান্য ঢালিয়া দিতেছেন দেখিয়া ঈর্ষায় তোমার অন্তস্তল জ্বলিয়া উঠে । তাঁহাদের হৃষ্টপুষ্ট সন্তানসকলের প্রফুল্ল মুখ-কমলের সহিত ক্ষুৎক্ষামকণ্ঠ; আচ্ছাদনবিরহিত, রোগে জর্জরিত তোমার সন্তানসকলের তুলনা করিয়া তুমি জগদম্বাকেই শত দোষে দোষী কর । অন্যের পদাঘাত-পীড়িত হইয়া তুমি অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিতে থাক । কিন্তু দোষ কাহার ? দেখিতেছ না, তাহারা অজ্ঞানসমরে সামর্থ্য প্রকাশ করিয়াই বড় হইয়াছে, আর তুমি সহস্ৰ বৎসরের অজ্ঞানকে হৃদয়ে অতি যত্নে পোষণ করিয়া নীরব, নিশ্চিন্ত আছ । উহারা বিদ্যারূপিণী শক্তির পূজায় অদম্য উৎসাহে অশেষ কষ্ট সহিয়াছে, অজস্র হৃদয়ের রু্ধির ব্যয় করিয়াছে, দশের কল্যাণের জন্য আত্মবলি দিয়া দেবীকে প্ৰসন্না করিয়াছে, আর তুমি অবিদ্যাসেবায় যথাসর্বস্ব পণ করিয়া ক্ষুদ্র স্বার্থসুখ লইয়া বসিয়া আছ । জগন্মাতা তোমায় দিবেন কেন ? শাস্ত্র যে তোমায় বার বার বলিতেছেন, তিনি বলিপ্রিয়া, রুধিরপ্রিয়া । দেবীর ঐ ভাব তাঁহার ধ্যানমন্ত্রেই রহিয়াছে । ঐ শুন, ভারতের তন্ত্রকার তোমায় কিভাবে শক্তির ধ্যান করিতে বলিতেছেন -
“শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংষ্ট্রাং বরপ্রনদাম্‌ ৷
হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্ৰাঞ্চ কপালকর্তৃকাকরাম্‌ ৷৷
মুক্তকেশীং লোলজিহ্বাং পিবন্তীং ক্লধরং মুহুঃ ৷
চতুৰ্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাং স্মরেৎ ৷৷”
প্ৰতি কার্যে মহাশ্ৰদ্ধাসম্পন্ন হইয়া স্বাৰ্থসুখত্যাগে আত্মবলিদানে তাঁহার তৰ্পণ কর, তাঁহাকে প্ৰসন্ন কর, দেখিবে শক্তিরূপিণী জগদম্বা তোমারও প্রতি পুনরায় ফিরিয়া চাহিবেন । তোমার নয়নে দীপ্তি, বাহুতে বল, হৃদয়ে তেজ, অন্তরে অদম্য উৎসাহরূপে প্ৰকাশিত হইবেন । দেখিবে জগন্মাতার নিত্য সহচরী দল - বুদ্ধি, লজ্জা, ধৃতি, মেধা প্রভৃতি আবার তোমার উপর প্ৰসন্না হইয়া প্রতি কার্যে তোমার সহায়তা করিবেন ।

এক-একটি নূতন ভাব গ্ৰহণ করতে আমাদের কতই না দাঙ্গা-হাঙ্গামা করিতে হইয়াছে ও হইতেছে । ব্যবহারিক জগতে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীভাব লইয়া ফ্রান্সের বিপ্লবের কথা এবং অধুনাতন জাপান-যুদ্ধের কথাই দৃষ্টান্তরূপে ভাবিয়া দেখ না । ব্যবহারিক, রাজনৈতিক জগতে যদ্রূপ, আধ্যাত্মিক জগতেও ঐ বিষয়ে ঠিক তদ্রূপ । সেইজন্যই কি গুরুরূপী মহাশক্তি-প্রকাশে ধর্মবিপ্লবের কথা শাস্ত্ৰপ্ৰসিদ্ধ ? কিন্তু প্ৰবল ঝটিকার পরেই প্রকৃতি শান্তভাব ধারণ করে, কার্যের পরই বিরামের স্বভাবতঃ উদয় হয় এবং ঐ প্রকার বিপ্লবের পরেই শান্তি ও জ্ঞান মনুষ্যসমাজে দৃঢ়তর অধিকার স্থাপন করিয়া বসে ।

গুরুরূপী শক্তির উদয়ে যে আধ্যাত্মিক জগতে ভাববিপ্লব সংঘটিত হইবে ইহা নিশ্চয় । তবে ঐ ভাববিপ্লব যে ধীরপদসঞ্চারে দেশময়, সমাজময় কখনও অধিকার স্থাপন করিতে পারে না, তাহাও নহে । ঝঞ্ঝাতাড়িত বজ্ৰ-বিলোড়িত বিচ্ছিন্নবক্ষ জলধিজলে স্ফীতি ও তরঙ্গের প্রসার - উহা এক ভাব । আর চন্দ্ৰোদয়ে স্নিগ্ধ কিরণবিপ্লাবিত সমুদ্রবক্ষের উল্লাস ও স্ফীতি - উহা আর এক ভাব । অমিতাভ বুদ্ধ, জ্ঞানগুরু শঙ্কর, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতির উদয়কালের কথা তুলনায় স্মরণ কর - তাহা হইলেই ঐ কথা হৃদয়ঙ্গম হইবে ।

অবতার জগদ্‌গুরু - মনুষ্যরূপে ঈশ্বর । মনুষ্যত্বে ঈশ্বরত্বের অপূর্ব মিলন-মানুষে অমানুষী দৈবী শক্তির বিকাশ - শক্তিপ্রসূত সংসার-মহীরুহের ফুল্লবিকশিত পারিজাত ঈশ্বর সংসারে সমগ্ৰ শক্তির ব্যবহার, চালন ও যথার্থভাবে নিয়মন করেন, কিন্তু কখনও তাহার বশীভূত হইয়া আত্মবিস্মৃত, স্তব্ধ বা মূঢ় হইয়া তাহার হস্তে ক্রীড়াপুত্তলিত্ব প্ৰাপ্ত হয়েন না । হে জগদ্‌গুরো, মানবমূর্তি পরিগ্রহ করলেও তোমার জগৎকারণজ্ঞান এবং তৎসহিত নিজের একত্বজ্ঞানের কখনও লোপ হয় না । মায়ায় ভিতর থাকিলেও তোমায় তৃতীয় চক্ষু সর্বদা অনাবৃত থাকিয়া মায়ার পারের বস্তু নিরীক্ষণ করিতে থাকে আর মনুষ্যসাধারণকে মোহিত করিয়া দাসভাবে পরিণত করিয়া রাখিয়াছে যত প্ৰকাৱ শব্দস্পর্শাদি, তাহারাও তাহাদের প্রভাব সহস্ৰ চেষ্টাতেও তোমার উপর কখনও বিস্তা্র করিতে পারে না । কেনই বা তোমায় নররূপে ঈশ্বর না বলিব ?

অবতার - জগদ্‌গুরু নররূপে ঈশ্বর । ঈশ্বর সর্বাবস্থায় সর্বভাবে পূর্ণ - নিজের কোন অভাব না থাকায় তৎপরিপূরণের জন্য কোন চেষ্টারও তাঁহার প্রয়োজন নাই, অথচ জগতের যাবতীয় চেষ্টার মূলই তিনি । হে নিত্যমুক্ত আত্মারাম গুরো, তোমারও স্বরূপজ্ঞান সর্বদা প্রকাশিত । অথচ নিজের কোন অভাব না থাকিলেও তুমি সমাজের কল্যাণারথ দিবারাত্র চেষ্টা করিয়া থাক । তোমার আহার, বিহার, নিদ্রা, জাগরণ, চেষ্টা, বিরাম, সংসার, সন্ন্যাস প্রভৃতি সকলই অপরের জন্য । কেনই বা তোমাকে মনুষ্যরূপে ভগবান না বলিব ?

অবতার - জগদগুরু মানুষী তনুতে ঐশী শক্তি । ঈশ্বরের শক্তি ও মহিমায় যেমন 'ইতি' নাই, তোমারও তদ্রূপ । তোমা ভিন্ন আর কে পূর্ব-সংস্কার দৃঢ় পাষাণসদৃশ, মনুষ্যমনকে ইচ্ছামাত্রে গলাইয়া, নিজের ছাঁচে ঢালিয়া, নূতন সত্যধারণোপযোগী গঠন দিতে পারে ? কেই বা শরীরস্পৰ্শ-মাত্রেই অহংগ্ৰন্থি শিথিল করিয়া মানুষকে কামকাঞ্চনাতীত ভাব ও সমাধি-রাজ্যে বিচরণ করাইতে পারে ? কেই বা “যতোই বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ”-রূপ পরমাধামে উপনীত হইবার নূতন নূতন পথ আবিষ্কার করিয়া ভিন্ন ভিন্ন প্ৰকৃতিবিশিষ্ট অধিকারীর নিকট তল্লাভ সুগম করিয়া দিতে পারে ? কেই বা সকল ভাবের সমান মর্যাদা রক্ষা করিয়া তাহদের চরম লক্ষ্য যে একই, একথা নিজ জীবনে প্ৰমাণিত করিতে পারে ? কেই বা বিপরীত ভাব ও বিপরীত মতসমূহের মধ্যে “সূত্রে মণিগণা ইব” সমন্বয়সুত্র প্রত্যক্ষ করাইয়া মনুষ্যজ্ঞানের উদারতা সম্পাদনা করিয়া দিতে পারে ? কেই বা বহুজনহিতায় যুগে যুগে স্বেচ্ছায় মনুষ্যভাবাপন্ন হইয়া অসীম উৎসাহে আদর্শের পর আদর্শসমূহ নিজ জীবনে পরিণত করিয়া মনুষ্যমনে তদনুরূপ অনুষ্ঠানের সাহস ও বলের উদ্দীপন করিয়া দিতে পারে ?

হে নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তভাব, অপারমহিম, কেন্দ্রীভূতবিদ্যারূপ আত্মারাম গুরো, তোমার কৃপায় ভারত সৰ্বকাল পুণ্যক্ষেত্র, ধর্মক্ষেত্র, জানবীর্যের আকরভূমি । তোমাকে ভুলিয়াই ভারতের এ দুঃখ, দারিদ্র, অজ্ঞান । সে ভুলিলেও তুমি তাহাকে ভুলিয়া থাকিও না । গুপ্তভাবে*  উদিত হইয়া ভারতের এবং তদ্বারা সমগ্র জগতের কল্যাণের জন্য যে অমোঘ জ্ঞান ও ভক্তিবীজ রোপণ করিয়া গিয়াছে, যাহার কিছুমাত্র পাশ্চাত্ত্যে পড়িয়া তথায় অপূর্বভাব বিপ্লব সম্পাদন করিতেছে, হে দেব, হে দয়ানিধে, উহা যাহাতে ভারতে ফলেফুলে সমাচ্ছন্ন মহাবৃক্ষরূপে পরিণত হইয়া প্রত্যেক নরনারীর প্রাণে বল, উৎসাহ, উদ্যম, অধ্যবসায়াদিরূপ ছায়া বিতরণ করিয়া আমাদের আধ্যাত্মিক দুর্দশা ও সংসারতাপের অবসান করে, তাহাই কর - তাহাই কর ।

আর তুমি হে শ্ৰদ্ধাসম্পন্ন শ্রোতা, তুমিও ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণ ও বীরেশ্বর^ শ্ৰীবিবেকানন্দ-প্রচারিত মহাসত্যসকল যত্নে হৃদয়ে ধারণ করিয়া সেই অপার-মহিম অপ্ৰতিহতপ্রভাব গুরুশক্তির কথা ভারতের ঘরে ঘরে প্রচারে দৃঢ়বদ্ধ-পরিকর হইয়া “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌নিবোধত”-রূপ অভয়বাণী-উচ্চারণে সকলের প্রাণে আশার সঞ্চার কর । নবযুগে তোমাতে নবশক্তি সঞ্চারিত হউক - প্ৰকাশিত হউক ।

_________________________________________
* শ্রীরামকৃষ্ণ আপন অন্তরঙ্গ শিষ্যমণ্ডলীর নিকট আপন অবতারত্বের কথায় বলিতেন –“রাজা যেমন প্রজাদের অবস্থা জানিবার জন্য ছদ্মবেশে শহর দেখতে বেরোয়, এবার সেই রকম জানবি ।”

^স্বামী বিবেকানন্দের পিতামাতা-প্রদত্ত অন্যতম নাম ।

_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment