Thursday, April 20, 2017

শক্তিপ্রতীক-১ (Power-worship : Shakti Symbol-1)


4.1) শক্তিপ্রতীক : অবতার, গুরু, সিদ্ধপুরুষ, মন্ত্রদাতা, উপগুরু ও শিক্ষক

(Power-symbols : Avatar, Guru, Yogi, Mantra-giver, sub-Guru & Teacher) 

শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিতেন, “গাছ পাথর নিয়ে ভগবানের বিশেষ লীলার প্রকাশ নয়, কিন্তু মানুষের মনই তাঁর বিশেষ লীলার স্থান ।” আবার বলিতেন -“যদি মানুষ না থাক্‌ত, ভক্ত না থাক্‌ত ত ভগবানকে পুঁছত কে – জান্‌ত কে - তাঁর অপার শক্তি, মহিমার কথা বেদবেদান্ত লিখে প্রচার করত কে ? ভক্ত আছে, তাই ভগবান আছে ।” আবার বলিতেন – “ভাগবত, ভক্ত, ভগবান - তিনে এক, একে তিন ।”

বিশেষ শক্তিমৎ পদার্থনিচয় বা শক্তিপ্রতীকসমূহের আলোচনায় প্ৰবৃত্ত হইয়া আমরা প্রথমেই মানবো শক্তিপূজার বা গুরুপূজার অবতারণা করিয়াছি । ইহাতে কেহ যেন না অনুমান করেন যে, মানবের ভিতয়েই বুঝি মানব প্রথম বিশেষ শক্তির পরিচয় পাইয়া তদুপাসনায় নিযুক্ত হয় — গুরুপূজাই বুঝি সে সর্বাগ্রে করিতে শিখিয়া ছিল । মানবপ্রকৃতির ইতিহাস বলে - আমরা অত সহজে সরল পথে চলি না; অতি সন্নিকট পদার্থই আমাদের অতিদূরে বর্তমান; নিজের ঘর না সামলাইয়া - আগেই পরের ঘর সামলাইতে অগ্রসর হওয়া আমাদের স্বতঃসিদ্ধ জাতীয় স্বভাব ! নতুবা যথার্থ জ্ঞান ও সভ্যতা এতদিন জগতে অনেক দূর অগ্রসর হইত !

মানবে প্রকাশ্যভাবে শক্তিপূজা জগৎ অল্পকালই করিতে শিখিয়াছে । ভারতেই ঐ পূজার প্রথম অভ্যুদয় এবং ভারত হইতেই জগতে ঐ পূজার প্রথম প্রচার । স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন “ভারত হইতেই প্ৰবল ধর্মতরঙ্গ কালে কালে উত্থিত হইয়া জগতের সর্বত্র প্রসারিত হইয়াছে এবং পরেও চিরকাল হইতে থাকিবে ।” বৈদিক যুগ হইতেই উহার আভাস পাওয়া যায়; বৌদ্ধযুগের কথা ত নিঃসন্দেহ প্রমাণিত, এবং বর্তমান যুগের বেদান্ত প্রচার আবার, আমাদের চক্ষুসমক্ষেই অভিনীত ! ইতিহাস যেখানেই কালের অন্ধকার ভেদে সমর্থ হইয়াছে এবং হইতেছে, সেখানেই স্বামিজীর ঐ কথা প্ৰমাণিত হইতেছে ।

ভারতেই গুরুরূপী ঐশী শক্তির মানবে প্ৰথম বিকাশ । - ব্ৰহ্মজ্ঞ বৈদিক ঋষিকূলই তাহার প্রমাণ । অবতাররূপী মহাশক্তিকেন্দ্ৰ ভারতেই প্রথম উদিত হইয়া জগতে মহাবিপ্লব আনয়ন এবং সভ্যতা ও জ্ঞানালোক বিকিরণ করিয়াছিল – ভগবান্‌ বুদ্ধ ও তাঁহার পরবর্তী প্রচারকগণের কার্যেই উহা প্রমাণিত । নাগার্জুন প্ৰভৃতি বৌদ্ধ প্রচারকগণের তাতার, চীনজাপানাধিকার - মহারাজ ধর্মাশোকের ইজিপ্ট, আসিয়া-মাইনর, পারস্য প্ৰভৃতি দেশে প্রচারক প্রেরণ এবং এখনও বিদ্যমান শাসনস্তম্ভরাজির কথা স্মরণ কর । বহুকালাভ্যস্ত শ্ৰীগুরুর পূজা এখন ভারতের মজ্জাগত প্ৰাণ ।

অবতার, আধ্যাত্মিক রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট্‌, সর্বদেশের সর্বকালের লোকগুরু, কালে কালে অনেক হইলে ও একই ব্যক্তি, কখনও গুপ্ত কখনও ব্যক্তভাবে উদিত হইয়া চিরকাল জনকল্যাণে রত !

ঐশী সম্পূর্ণতা এবং মানুষী দুর্বলতার অপরূপ মিলনভূমি — তাঁহার শরীর ও মন । স্থূলবুদ্ধি মানবমনে বিপরীত ধর্মভাবের সামঞ্জস্য করিতে যাইয়া পুরাণকার হরিহর, অর্ধনারীশ্বরাদি অপূর্ব দেবমূর্তিসকলের কল্পনা করিয়াছেন - বিপরীত ধর্মশীল অপূর্ব অবতারবিগ্ৰহই কি তাঁহার সে কল্পনার মূলে ?
“অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্‌ ৷
পরং ভাবমজানন্তে মম ভূতমহেশ্বরম ॥ - [গীতা]
অবতাররূপী গুরুকে সম্যক জানিতে ও চিনিতে কে সমর্থ ? তিনি সৰ্বকালেই পরমাত্মার ন্যায় “যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ” - যাহার নিকটে ইচ্ছা, কৃপায় স্বস্বরূপ প্ৰকাশ করিয়া থাকেন ! তাঁহার স্বরূপ লক্ষণ তাঁহারই প্ৰমুখাৎ শুনিয়া শ্রুতি-স্মৃত্যাদি ধর্মশাস্ত্ৰ যতটুকু লিপিবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহারই সংক্ষেপ মর্ম আমরা নিম্নে প্ৰদান করিয়া জগদগুরু অবতারপুরুষে শক্তিপূজার কথা সমাপন করিব ।

১) কে তিনি, পূর্বে কি ছিলেন, এ জন্মে মনুষ্যশরীর পরিগ্ৰহ করিয়া তাঁহার আগমনকারণই বা কি ? - ইত্যাদি জ্ঞানের স্ফূর্তি অবতারপুরুষে আশৈশব অল্পাধিক বর্তমান থাকে । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণে ঐ জ্ঞানের সর্বাপেক্ষা সমধিক বিকাশ ছিল, - একথা ভারতের ধৰ্মেতিহাস-প্ৰসিদ্ধ ।

২) অভাব বোধই আমাদের যাবতীয় চেষ্টার মূলে এবং তদভাব পূরণ না হইলেই দুঃখ । নিজের অভাব বোধ না থাকায়, অপরের অভাব বোধ হইতে অথবা অপরের অভাব বিশেষ দূর করিতেই অবতারপুরুষে সমস্ত চেষ্টার আবির্ভাব হয় । সে একাঙ্গী চেষ্টার অমিতবেগ পুরুষ সাধারণের অভাববোধপ্ৰসুত চেষ্টাতেও কদাপি লক্ষিত হয় না । আজীবন নিঃস্বাৰ্থ চেষ্টা করিতে একমাত্র তাহারাই সমর্থ ।

৩) মনোরাজ্যে তাঁহাদের একাধিপত্য । আপন মনের উপর যদ্রূপ, অপরের মনের উপরেও তদ্রূপ । অপরের মনের কর্মসঞ্চিত পূর্বসংস্কারসমূহ চূৰ্ণ বিচূর্ণ করিয়া স্বল্পকালেই নূতনভাবে নূতনাদর্শে গড়িতে তাঁহারাই সমর্থ । শরীরস্পর্শমাত্রেই অপরের মনে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করিয়া সমাধিস্থ করা বা ভাববিশেষ উপলব্ধি করানর কথা তাঁহাদের সম্বন্ধে সর্ব জাতির ধৰ্মেতিহাসেই বিদ্যমান ।

৪) পরমাত্মার প্রত্যক্ষীকরণের নূতন পথবিশেষ আবিষ্কার করা, অথবা জনসমাজে পূর্ববিদিত পথ বা ধর্মসমূহের ভিতর নূতন সম্বন্ধসুত্ৰাবিষ্কার করা এবং ঐ ভাবের নূতনাদর্শ নিজ জীবনে প্ৰদৰ্শন করিয়া জনসমাজে প্ৰবর্তিত করা তাঁহারাই সনাতনকাল হইতে করিয়া আসিতেছেন ।

৫) ধর্মাদর্শ ভিন্ন, অবতারপুরুষের জীবনে তাৎকালিক সমাজের নৈতিকাদর্শও স্বভাবতঃই সম্পূর্ণ পরিস্ফুট থাকে। নৈতিকাদর্শ ধর্মাদর্শ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এবং সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগে যুগে ভিন্নাকার ধারণ করে — এ কথাটি হৃদয়ঙ্গম না করিয়াই আমরা অনেক সময়ে সকল অবতারপুরুষের জীবনই একরূপ নৈতিকাদর্শে গঠিত দেখিবার প্রত্যাশা করিয়া থাকি এবং তাঁহাদের অলোকসামান্য চরিত্র ঐরূপে তুলনায় পাঠ করিতে যাইয়া ভ্রমে পতিত হই ।

৬) অবতার মুক্তকণ্ঠে জনসাধারণকে বলিয়া যান, “মামেব যে প্ৰপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে” - “Come unto Me all ye that labour and are heavy laden, and I will give you rest” [Matthew XI. 28] - “হে ত্রিতাপাবসন্ন জীবগণ, আমাকে আশ্রয় কর, আমি তোমাদের শান্তি দিব” - এবং তিনি যে লোকগুরু, ঈশ্বরাবতার - এ কথা প্ৰাণে প্ৰাণে স্বয়ং অনুভব করেন ও অপরকেও নিজ শক্তিবলে তদ্রূপ অনুভব করাইয়া থাকেন ।

অবতারপুরুষের সময়ে সময়ে গুপ্তভাবে আবির্ভাবের কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি । শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব এ সম্বন্ধে বলিতেন -“যেমন রাজা সেজোগুজে লোকজন সঙ্গে নিয়ে প্ৰকাশ্যভাবে ঢ্যাঁড়াপিটে নগর দেখ্‌তে বেরোন, আবার কখন ছদ্মবেশে প্রজাদের অবস্থা ও কার্যকলাপ দেখবার জন্য বেরোন এবং যেই প্ৰজারা টের পেয়ে কানাকানি করতে থাকে - ‘ইনিই রাজা - ছদ্মবেশে আমাদের ভিতর এসেছেন” - অমনি সেখান হতে পালান্‌, সেইরূপ অবতারের ব্যক্ত এবং গুপ্ত আবির্ভাব জান্‌বি ।”

শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব আর একটি কথা অবতার সম্বন্ধে বলিতেন - যথা “অবতারপুরুষের কোনকালে মুক্তি নাই ।” “যেমন সরকারি লোক, জমিদারীর যেখানে গোলযোগ উপস্থিত হবে সেখানেই তাকে তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে হবে এবং গোল থামাতে হবে, সেইরূপ ব্ৰহ্মময়ীর জমীদারীর (জগতের) যেখানেই গোল উপস্থিত হবে, সেখানেই অবতারপুরুষকে আবিভূর্ত হয়ে লোকের দুঃখ মোচন করতে হবে ।” এ কথায় কেহ যেন না অনুমান করেন যে, তবে বুঝি অবতারপুরুষকে চিরকালই মায়াধীন থাকিতে হয় । তিনি স্বভাবতঃই মায়াধীশ, আত্মারাম - কোন কালেই বদ্ধ হন না; অতএব তাঁহার মুক্তি কখন, কিরূপেই বা হইবে !

অবতারই আধ্যাত্মিক জগতে একমাত্র পথপ্রদর্শক । তাঁহাদের পবিত্র চরিত্রের পূজা জগৎ আবহমান কাল হইতে অবনতমস্তকে করিয়া আসিতেছে এবং চিরকালই করিবে । তাঁহাদের মনুষ্যশরীরপরিগ্রহে সমগ্ৰ মানবকুল ধন্য হইয়াছে । হে ভারত ! যুগে যুগে তুমিই তাঁহার বিশেষ কৃপাপাত্র হইয়া ধর্মজগতে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছ । তাঁহার সম্মান ও পূজা করিতে কখনও ভুলিও না ।

ঈশ্বরাবতারের পূজা ভিন্ন আধ্যাত্মিক জগতে ভারত সিদ্ধপুরুষ, মন্ত্রদাতা কুলগুরু, এবং উপগুরু প্ৰভৃতিরও চিরকাল সম্মান এবং পূজা করিয়া আসিতেছে । ইহাদের সম্বন্ধেও এখানে দুই চারিটি কথা বলা যাইতে পারে ।

সিদ্ধপুরুষ ঈশ্বরাবতার নির্দিষ্ট পথবিশেষে অগ্রসর হইয়া পূৰ্ণকাম ও জীবন্মুক্ত হন । ঐকালে তাঁহাতেও আর স্বার্থচেষ্টা অসম্ভব হইয়া উঠে, কারণ যথার্থ ধর্মানন্দলাভে তাঁহার
“যং লব্ধ চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ৷
যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ৷৷” - [গীতা]
— ঐ প্রকার অবস্থা লাভ হইয়া পৃথিবীর যাবতীয় সুখদুঃখাদি অতি তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইয়া যায় । অবতারপুরুষের ন্যায় শক্তির প্ৰকাশ না হইলেও, তাঁহাতে গুরুশক্তি প্ৰবুদ্ধ হইয়া নিয়ত লোককল্যাণে নিযুক্তা থাকেন । ধর্মজগতে নূতন পথাবিষ্কারে সমর্থ না হইলেও তাঁহার দর্শনে কামকাঞ্চনৈকদৃষ্টি স্থুলদর্শী মানব ছায়াপ্রতিম ধর্মাদর্শকে সচল, জীবন্ত বলিয়া অনুভব করিতে থাকে । ঈশ্বরাবতারের ন্যায় স্পর্শ বা ইচ্ছামাত্ৰেই ধর্মজীবন দানে সমর্থ না হইলেও, তাঁহাদের অপরের ধর্মজীবন উদ্দীপিত করিবার ইচ্ছা নিষ্ফল হয় না; এবং জাতিবিশেষের জীবনে এবং তন্মধ্য দিয়া অন্যান্য জাতির জীবনে উত্তাল তরঙ্গমালাসঙ্কুল ধর্মবন্যা খরস্রোতে প্ৰবাহিত করিয়া অবতারপুরুষের ন্যায় অপূর্ব পরিবর্তন সংসাধিত করিতে না পারিলেও, তাঁহারা আপন চতুষ্পার্শ্বস্থ জনসাধারণের মনে ধর্মস্রোত প্ৰবাহিত করিয়া ধন্য করিয়া থাকেন । সিদ্ধাত্মা মন্ত্রাদি অবলম্বনে অপরে ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করিয়া থাকেন । অবতারের কথা ছাড়িয়া দিলে, ইহাদের ন্যায় অপর কোন মানবেই ধর্মশক্তি সমধিক বিকশিত দেখা যায় না । অবতার ধর্মপ্ৰবর্তক; সিদ্ধাত্মা তৎপ্ৰবর্তিত ধৰ্মে জীবন গঠন করিয়া সেই ধর্মকে পুষ্ট রাখেন । ইঁহাদের পূজা করিলে, ইঁহাদের আদর্শে জীবন গঠন করিলে যে মানব ধন্য ও কৃতাৰ্থ হইবে, এ সম্বন্ধে অধিক বলা নিম্প্রয়োজন ।

স্থুল চক্ষুর গোচর না হইলেও ধর্ম জীবন্ত শক্তি ! অনুষ্ঠানে উহার ফল প্ৰত্যক্ষ অনুভব করিতে এবং অপরকেও অনুভব করাইতে পারা যায় । বিশেষ শক্তিসম্পন্ন পুরুষ আপন শরীরমন হইতে ঐ শক্তি অপরে সঞ্চারিত করিতে পারেন এবং ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোকসম্বন্ধীয় যে সকল অনুভব জীবনে প্ৰতক্ষ্য করা তাহার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, সে সকলও অপরকে সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষ করাইতে পারেন । - বহুকাল হইতে এসকল কথা প্ৰত্যক্ষ করিয়া ভারত বিশ্বাস করিয়া আসিতেছে ।

আবার বহুকালব্যাপী চেষ্টা, ধ্যান ও একাগ্রতার দ্বারা ভাববিশেষ উপলব্ধি করিয়া, তাহাকে শব্দবিশেষের সহিত এমন সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করা যাইতে পারে যে, উহার উচ্চারণমাত্রেই ঐ ভাববিশেষ উজ্জ্বল বর্ণে অপরের মনে উদিত হইয়া তাহাকে অপূর্ব অনুভব প্ৰত্যক্ষ করাইবে; এবং প্রত্যেক অনুভব যেমন ফলস্বরূপ আনন্দ বা দুঃখ প্রসব করিয়া মানবজীবন পরিবর্তিত করে, ঐ বিচিত্রানুভবেও তদ্রূপ তাহার মন বিশেষরূপে পরিবর্তিত হইয়া বিশেষ আনন্দ বা দুঃখের অধিকারী হইবে । উহারই নাম মন্ত্রশক্তি । ঐ মন্ত্রশক্তির প্রভাবও ভারত বহুকাল হইতে অবগত হইয়া তদারাধনায় নিত্য নিরত আছে । শঠ-ধূর্তের হস্তে সময়ে সময়ে প্ৰতারিত ও ক্ষতিগ্ৰস্ত হইলেও, উপযুক্ত গুরুসহায়ে ভারতে ঐ সকল বিষয়, পুরাকালে এবং অধুনা, বহুবার পরীক্ষিত এবং সত্য বলিয়া নির্ণিত হইয়াছে । মন্ত্রশক্তির উপর বিশ্বাসই মন্ত্রদাতা-গুরূপাসনার মূলে বর্তমান ।

অবতারপুরুষোচ্চারিত বাক্যসকলই যথার্থ মন্ত্র ও আশুফলপ্ৰদ ; কারণ উহাতে তাঁহাদের বিশেষ শক্তি নিহিত থাকে । সহস্ৰ বৎসর বা তদধিক কাল পরেও সে শক্তির স্বল্পাধিক পরিচয় পাওয়া যাইয়া থাকে । সিদ্ধপুরুষোচ্চারিত মন্ত্রও দ্বাদশ বৎসরের মধ্যেই ফল প্ৰত্যক্ষ করায়, ইহা লোক প্ৰসিদ্ধ । সাধুসাধকোচ্চারিত মন্ত্রের ফল উপলব্ধি করিতে তদপেক্ষাও অধিক কাল লাগে ।

মন্ত্রফল উপলব্ধি করিতে কেবল যে উপযুক্ত গুরু আবশ্যক তাহা নহে । “আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠো” ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন উপযুক্ত শিষ্যেই গুরুশক্তি সঞ্চারিত হইলে আশুফল প্ৰত্যক্ষ করাইয়া থাকে । সুফল লাভ করিতে এখানেও - উর্বর জমি, উত্তম কর্ষণ, উত্তম বীজ এবং তদুপরি ঐ বীজের যত্নের সহিত সংরক্ষা এবং জলসেকাদির প্ৰয়োজন । বীজ উত্তম হইলেও যে অনেক সময় মন্ত্রফল প্ৰত্যক্ষ হয় না, তাহার কারণ ঐ সকল প্ৰয়োজনীয় বিষয়গুলির অভাব ভিন্ন আর কিছুই নহে । আমাদের জনৈক শ্ৰদ্ধাস্পদ বন্ধু বলিতেন, “নোঙ্গর ফেলিয়া দাঁড় টানিলে যেমন নৌকা কখন অগ্রসর হয় না, সেইরূপ ঐ সকলের অভাব হইলে ভগবচ্ছক্তি উপলব্ধিরূপ প্ৰত্যাশাও বিফল হয় ।”

মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস বিষয়াসক্ত মনের অনেক সময় অপকারেরও কারণ হইয়া থাকে । এক ব্যক্তির মন অপর ব্যক্তির মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে জানিয়া কামক্রোধান্ধ পুরুষ অনেক সময়ে নিজ স্বাৰ্থতৃপ্তির আশয়ে ঐ শক্তির আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়া থাকে । অথবা দুৰ্বল নীচচেতা পশুবৃত্তি মানব, আপন পাশব-প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য, পবিত্র গুরুনামের অযোগ্য, অপর নীচতর পুরুষের সহায়ে ঐ শক্তি প্ৰয়োগ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে । বলা বাহুল্য যে, ঐরূপ চেষ্টা কদাচিৎ সফল হইলেও ঐ দুর্বৃত্তেরাই পরিণামে নানাবিধ দুঃখ অশান্তি এবং মানসিক অবনতিরূপ দণ্ড ভোগ করিয়া থাকে । তন্ত্রশাস্ত্রের অনেক স্থলে পবিত্ৰ ঐশী শক্তি আরাধনার বিশেষ বিধানের সঙ্গে সঙ্গে মারণ, উচাটন, বশীকরণাদির বিশেষ ব্যবস্থা দেখিয়া মনে হয়, পাশবপ্রকৃতি মানব উহা পরে বিশুদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের সহিত সংযুক্ত করিয়া ধৰ্মের নামে প্ৰবৃত্তির পৈশাচিক অভিনয় দেখাইয়া কলঙ্কিত করিয়াছে । বৌদ্ধধৰ্মের অধঃপতনকালে ভারতে যে ঐ প্রকার দুর্বৃত্তের সংখ্যা অধিক হইয়াছিল তাহাও ইতিহাসপ্রমাণিত । ঐ ধর্মগ্লানি দূর করিবার জন্যই পরে জ্ঞানগুরু শিবাবতার শঙ্করাচার্যের এবং ভক্তিপ্ৰাণ শ্ৰীচৈতন্যের ভারতে উদয় । তাঁহারাই পুনর্বার শক্তি উপাসনার পবিত্ৰাদর্শ জনসাধারণে দেখাইয়া শিবোক্ত তন্ত্রশাস্ত্রের যথার্থ মর্যাদা সংস্থাপন করিয়াছিলেন । শ্ৰীশঙ্করাচার্যলিখিত শিবদুর্গাদি-বিষয়িণী স্তবরাজি ও বিষ্ণুসহস্রনামের ভাষ্য এবং শ্ৰীচৈতন্যের অন্নপূর্ণা দেবীকে আপন ইষ্টরূপে উপাসনাতেই উহা অবগত হওয়া যায় । অন্নপূর্ণা শ্ৰীশঙ্করেরও যে ইষ্টদেবী ছিলেন ইহারও প্ৰমাণ পাওয়া যায় ।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ দেব বলিতেন, “প্রত্যেক অবতারই সযত্নে শক্তির উপাসনা করিয়া গিয়াছেন । শক্তির বিশেষ অনুগ্রহলাভ না করিয়া কখনই লোকগুরুত্ব লাভ করিতে পারা যায় না, অথবা ধর্মভাগীরথীর প্ৰবল তরঙ্গে দেশ আপ্লাবিত করিয়া জনসাধারণে যথার্থ ধর্ম প্রচার করিতে পারা যায় না ।” শ্ৰীচৈতন্যের বেদান্তভাব বা শক্তি উপাসনার কথা শুনা যায় না বলিয়া আপত্তি উত্থাপিত হইলে, শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব আমাদের বলিয়াছিলেন, “যেমন হাতীর দুই প্ৰকার দাঁত থাকে, এক প্রকার বাহিরে, শত্রু আক্রমণ করিবার জন্য, এবং অপর প্রকার ভিতরে, খাইবার জন্য - শ্ৰীচৈতন্যেও সেইরূপ দুইপ্ৰকার ভাব ছিল । ভক্তি তাঁহার বাহিরের ভাব - সাধারণের নিকট প্রচারের জন্য; এবং বেদান্ত ও শক্তি উপাসনা তাঁহার ভিতরের ভাব - উহা নিজের জন্য; কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ এবং অন্নপূর্ণা দেবীর উপাসনাতেই উহা বুঝা যায় ।”

যে শক্তিরই উপাসনা কর, অতি পবিত্রভাবে শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া অগ্রসর হইতে হইবে । স্বাৰ্থানুসন্ধানের নাম গন্ধ পর্যন্ত মন হইতে দূরে রাখিতে হইবে । নতুবা উপাসনায় সিদ্ধিলাভ অসম্ভব এবং অনেক সময়ে বিপরীত ফলেরও উদয় হইয়া উপাসককে অবসন্ন করে । এ কথাটি মনে সর্বদা জাগরূক রাখিয়া অগ্রসর হইতে হইবে । অযথা শক্তি প্ৰয়োগে বা নিজের স্বাৰ্থসুখের জন্য শক্তি, প্ৰয়োগে পরিণামে শক্তি হানি এবং দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হইবে নিশ্চয় । অগ্নি লইয়া খেলা করিতে যাইয়া অনেকে অনেক সময় নিজের গাত্র ও গৃহাদি দগ্ধ করিয়া বসে । স্থূল শক্তিতে উহা যেমন, সূক্ষ্ম শক্তির সহিত খেলাতেও ঠিক তদ্রূপ, বরং অধিক কুফল প্রসব করে । শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, সর্বপ্রকার শক্তির প্রয়োগই জানিয়া শুনিয়া শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সাবধানে করিতে হইবে । শারীরিক শক্তির অপব্যয়ে কত লোকেই না অকালবৃদ্ধ হইয়া আক্ষেপভারপীড়িত জীবন বহন করিয়া আপনাকে ও সমাজকে দুৰ্বল করিয়া ফেলে । মানসিক শক্তির অপব্যয়ে কত লোকেই না আবার মেধাশূন্য, অস্থিরমনা ও উন্মাদপ্রায় হইয়া আপনাকে এবং অপরকে অধিকতর ক্ষতিগ্ৰস্ত করে । আবার আধ্যাত্মিক শক্তির অপব্যয়ে কতবার যে ভারত ও ভারতেতর দেশসমূহ পশু, বর্বরতুল্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহাও ইতিহাস সাক্ষ্য দিতেছে । হে উপাসক ! এ সকল দৃষ্টান্ত মনে রাখিয়া শ্রদ্ধার সহিত সাবধানে শক্তিপূজায় অগ্রসর হইও ।

মন্ত্রদাতা-গুরূপাসনার কথা প্রসঙ্গে বঙ্গের লৌকিকাচার - কুলগুরু ও গুরুবংশের উপাসনার কথা মনে উদয় হয় । আমরা উহাকে বঙ্গেরই আচারবিশেষ বলিলাম, কারণ, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ঐরূপ আচার আমাদের নয়নগোচর হয় নাই । সেখানে সংসারত্যাগী সাধু বা নিষ্ঠাবান্‌ ধাৰ্মিক গৃহস্থ - যাঁহার উপরেই কোন ব্যক্তির হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভক্তির উদয় হইয়া থাকে, তাঁহারই নিকট হইতে মন্ত্রগ্রহণের রীতি প্রচলিত । সংসারত্যাগী গুরু হইলে তিনি যে, কোন্‌ প্রদেশের কোন্‌ বংশে, জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহার ঠিকানাই অনেক সময়ে পাওয়া যায় না । কাজেই গুরুকুলের উপাসনা অসম্ভব হইয়া পড়ে; এবং ধাৰ্মিক গৃহস্থ গুরু হইলে, তাঁহার জীবৎকাল পর্যন্ত বা তাঁহার শরীরত্যাগের কিছু পর পর্যন্ত শিষ্যের ভক্তি ঐ বংশের উপর প্রবাহিত থাকে, এই পর্যন্ত । কিন্তু গুরুর পুত্ৰ উপযুক্ত হউন বা নাই হউন এবং শিষ্যপুত্রের তাঁহার উপর শ্রদ্ধার উদয় হউক বা নাই হউক, তাঁহার নিকট হইতেই মন্ত্র গ্ৰহণ করিয়া তাঁহাকে ঈশ্বর লাভের সহায়রূপে গ্ৰহণ করিতে হইবে - এ প্রথার প্রচলন নাই ।

বঙ্গে সংসারত্যাগী সাধুর সংখ্যা অল্প হওয়াতে এবং পিতার গুণ সন্তানে উপগত হয় - এই বিশ্বাস থাকাতে, ঐরূপ প্ৰথা প্ৰচলিত বলিয়া বোধ হয় । শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের পুণ্যাবির্ভাবের পূর্বে ভদ্র বংশীয়দের সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণের কথা প্ৰায় শ্ৰবণগোচরই হইত না । বিরল কেহ কেহ উত্তরপশ্চিম-প্ৰদেশাগত কোন কোন সাধুসন্ন্যাসীর ভাবে মুগ্ধ হইয়া ঐ পথ অবলম্বন করিলেও প্ৰায় জন্মের মত দেশত্যাগ করিয়া যাইত । কাজেই তাহাদের দ্বারা বঙ্গে আর ঐ সম্প্রদায় বৃদ্ধি পাইত না । আবার বঙ্গে তন্ত্রমতের সমধিক প্ৰচলন থাকাতে এবং ঐ মতে সস্ত্রীক ধর্মোপাসনায় আশু ভগবৎকৃপা লাভ হয় প্রচার থাকাতে, নিষ্ঠাবান্‌ উদারমনা গৃহস্থকে গুরুরূপে বরণ করার প্রথাই প্ৰচলিত হয় ।

বঙ্গের ঐ আচার এখন অনেকাংশে দূষণীয় হইলেও যতদিন না গুরুকুলের শিষ্যব্যবসায়বৃত্তি বা তদ্বারাই জীবিকানিৰ্বাহ করা রূপ কুপ্রথার প্রচলন হয়, ততদিন পর্যন্ত এ প্রদেশের অনেক কল্যাণ সাধন করিয়াছে । উহা গুরুবংশের সন্তানগণের ভিতর গুরুনামের উপযুক্ত হইবার বাসনা প্ৰবল রাখিয়া বিদ্যা ও সদাচার পুষ্ট রাখিয়াছিল । আবার সমাজে এক শ্রেণী অনেকটা নিশ্চিন্তমনে কেবল ধর্মচৰ্চাতে নিযুক্ত থাকায় ধর্মাদর্শও তাঁহাদের ভিতর উজ্জ্বল থাকিয়া লোককল্যাণ সাধন করিত । ঔপনিষদিক সময়ে ঋষিকুল গৃহস্থ হইলেও ঐরূপ অবসর লাভে ধর্মচর্চায় নিযুক্ত থাকিয়া সমগ্ৰ দেশ এবং জাতির যে কত কল্যাণ সাধন করিয়াছিলেন, তাহা সর্বজনবিদিত ।

পূর্বে বঙ্গে অন্নও সুপ্ৰতুল ছিল । মুসলমান রাজাধিকারেও সময়ে সময়ে টাকায় আট মণ চাউলের কথা ইতিহাস প্ৰসিদ্ধ । এখন অন্ন পর্যাপ্ত জন্মিলেও বাষ্পীয় শকটের কৃপায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং বাষ্পীয় পোতবাহনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানির প্ৰবল স্রোতে বঙ্গের অন্ন অন্যত্ৰ নীত হয় । তদুপরি বিলাতি সভ্যতার মহার্ঘতা, বিদ্যাশিক্ষার বিপরীত ব্যয় প্রভৃতি নানা কারণে গুরু এবং শিষ্য উভয়েই ব্যতিব্যস্ত । উভয়কেই নানা উপায়ে কথঞ্চিৎ জীবিকানিৰ্বাহ করিতে হইতেছে । পরিশ্রম না করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া জীবিকানিৰ্বাহ গুরুকুলের বহুকালাভ্যস্ত । সেজন্য তাঁহারাই সমধিক বিপদে পতিত হইয়াছেন; এবং মিথ্যাভাষণ, চাটুকারিতা প্রভৃতি নীচ উপায় সমূহ অবলম্বন করিয়া শিষ্যবর্গের মনোরঞ্জন দ্বারা অর্থসংগ্রহে মনোনিবেশ করিয়া, তাঁহাদের অনেকেই এককালে ধর্মতেজোবিহীন হইয়া হতশ্ৰী ও ইতর হইয়া পড়িয়াছেন । উপযুক্ত গুরুর অভাবে শিষ্যের ভক্তিও হ্রাস পাইয়াছে । এখন এ প্রথার উচ্ছেদ অনিবাৰ্য এবং উচ্ছেদ হইলেও দেশের অকল্যাণ বলিয়া বোধ হয় না ।

আবার দেখা যায়, অবতার অথবা বিশেষ শক্তিসম্পন্ন ধর্মাত্মা মহাপুরুষ যে বংশ পবিত্র করেন, তাহার প্রায়শঃ লোপ হইয়া থাকে; অথবা সে বংশে আর সেরূপ শক্তিমান পুরুষের আবির্ভাব দেখিতে পাওয়া যায় না । স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, “Genius বা বিশেষ শক্তিমান পুরুষ কোনও বংশে জন্মিবার কালে ঐ বংশের পূৰ্বাপর যাবতীয় শক্তি যেমন নিঃশেষে আকৰ্ষিত হইয়া তাঁহাতে সমাবিষ্ট এবং প্ৰকাশিত হয় । সে জন্যই তাঁহার জন্মের পর ঐ বংশে বাতুল, শ্ৰীহীন বা অতি সাধারণ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণই জন্মগ্রহণ করে এবং ক্রমে ঐ বংশের অনেক স্থলে লোপও হইয়া যায় ।” সেইজন্য অবতার বা সিদ্ধপুরুষ যে বংশ পবিত্র করিয়া থাকেন, তাহার উপর স্বতঃই লোকের শ্রদ্ধা ভক্তি প্রবাহিত হইলেও উহাতে ধর্মশক্তির প্রকাশ সৰ্বকাল স্থির থাকে না । উহাও বোধ হয় শিষ্য কুলের গুরুকুলের উপর ক্রমশঃ ভক্তিহীনতার অন্যতম কারণ ।

মন্ত্রদাতা গুরু একজন হইলেও শিষ্য তাঁহার নিকট যাহা শিক্ষিতব্য শিক্ষা ও নিজ জীবনে সাধন করিয়া ধর্মবিষয়িণী অপর শিক্ষাসমূহ অপর গুরুর নিকটে যে সম্পূর্ণ করিতে পারে, ইহা বেদাদি সৰ্বশান্ত্রের বিধান । যাঁহারা ঐ রূপ শিক্ষার সহায়তা করেন, তাঁহারাই উপগুরু নামে প্ৰসিদ্ধ ।

আধ্যাত্মিক জগতে গুরূপাসনা ভিন্ন ভারতে ব্যবহারিক অপরা বিদ্যা - যথা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যাদি - বা অর্থকরী বিদ্যার শিক্ষয়িতারও বিশেষ সম্মান এবং পূজাবিধান আছে । বর্তমানকালে উহার বিশেষ অভাব লক্ষিত হইয়া থাকে । উহাতে গুরু এবং শিষ্য অথবা শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়েরই দোষ বর্তমান বলিয়া বোধ হয় । শিক্ষক ছাত্ৰাদিগকে নিজ তনয়ের ন্যায় ভালবাসা ও স্নেহের চক্ষে দর্শন করেন না, ছাত্রেরাও শিক্ষককে পিতার ন্যায় ভক্তি ভালবাসা প্ৰদৰ্শন করে না । স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন, “শ্রদ্ধাহীনতাই আমাদের শিক্ষাজগতে সর্বনাশ সাধন করিতেছে এবং শ্রদ্ধার অভাবেই আমাদের বালকদিগের যথাৰ্থ শিক্ষালাভ হইতেছে না ।” ছাত্র ও শিক্ষকের ভিতর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্বন্ধ থাকতে এবং বিদ্যা যে কেবল অর্থোপার্জনের জন্য নহে - জ্ঞানলাভের জন্য, এই ভাব বর্তমান থাকাতেই ইউরোপে অধুনা বিদ্যার এত উন্নতি হইয়াছে । শিক্ষাকালে গুরুর সহিত একত্ৰ বাসের এবং তাঁহার প্রত্যেক কার্য দেখিয়া তাঁহার প্রতি যাহাতে ভক্তি উদয় হয়, সে সকল বন্দোবস্তের অভাবই ঐ প্রকার শ্রদ্ধাহীনতার কারণ বলিয়া বোধ হয় । পুরাকালে ব্ৰহ্মচারী ছাত্ৰগণ গুরুকুলে বাস করিয়া যে কতদূর যথার্থ শিক্ষালাভ করিত, তাহা পুরাণেতিহাস পাঠে জানিতে পারা যায় ।

মানবে গুরুরূপিণী ঐশী শক্তি আবিভূর্তা হইয়া মানবজাতির পরম কল্যাণসাধনে যে প্ৰবৃত্ত হন, অথবা বর্বর, বন্য মানবকে সমাজ, নীতি, বিদ্যা, ধর্মাদি আলোক-দানে দেবতা করিয়া তুলেন - একথার পরিচয় ভারত যেদিন হইতে পাইয়াছে, সেই দিন হইতেই বুঝিয়াছে, গুরু মনুষ্য নহেন - গুরু নরশরীরে ঐশী বিকাশ ! সে দিন হইতেই “গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ” প্রভৃতি মন্ত্রের প্রচার । সেই সময় হইতেই প্রচার -
“যস্য দেবে পরা "ভক্তিৰ্যথা দেবে তথা গুরৌ ৷
তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্ৰকাশন্তে মহাত্মনঃ ৷৷” - [শ্বেতাশ্বতর ]
গুরুতে মনুষ্যবুদ্ধি করিলে কখনও জ্ঞানলাভ হয় না । হে ভারত ! শ্ৰীগুরুর মূর্তিতে শক্তিপূজা করিতে যতদিন তুমি না ভূলিবে ততদিন পৃথিবীতে এমন কে আছে যে তোমার জাতীয় জীবন বা শক্তির লোপ করিতে পারে ? গুরুবলে বলীয়ান ! গুরুরূপী ধ্রুবতারানিবদ্ধদৃষ্টি হইয়া গন্তব্যপথে অগ্রসর হও !

আর তুমি, হে নিত্যমুক্ত আত্মারাম গুরো ! - তুমি আমাদের জ্ঞানচক্ষু সম্যক্‌ প্ৰস্ফুটিত কর ! তোমাকে বার বার প্রণাম করি ! তোমার কৃপায় প্রত্যেক ভারত-ভারতী নবীন আধ্যাত্মিক জীবনের দিব্যভাবের অমিততেজে সম্যক্‌ উদ্ধুদ্ধ হউক এবং শ্রদ্ধাসহকারে তোমার পূজা করিয়া দেশের কল্যাণের জন্য নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ বলিদানে সমর্থ হউক ! হে শ্যামা, গুরুরূপিণি ! পদাশ্ৰিত ভারতে নবযুগে নবশক্তি সঞ্চারিত কর ! যাহাতে তোমার শ্ৰীমূর্তির জীবন্ত পূজা প্রচারে সে চিরকৃতাৰ্থ হইতে পারে, অপরকেও তদ্রূপ করিতে পারে ।


_________________________________________
Scanned Copy Sources :

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.


Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous--Contents--Next>

No comments:

Post a Comment