Thursday, April 20, 2017

সূচিপত্র (Power-worship : Contents)

<Next>

ভারতে শক্তিপূজা


সূচীপত্র


1)নিবেদন 
4)শক্তিপ্রতীক


1) নিবেদন (Preface)


“ভারতে শক্তিপূজা”র প্রথমভাগ প্ৰকাশিত হইল । সাধারণে ইহার আদর দেখিলে, দ্বিতীয়ভাগ প্ৰকাশের ইচ্ছা রহিল । (গ্ৰন্থকারের এ অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই । তিনি বিগত ১৩৩৪ সালের ১লা ভাদ্র দেহ রক্ষা করেন ।)

শক্তিপূজা, বিশেষতঃ মাতৃভাবে শক্তিপূজা ভারতেরই নিজস্ব সম্পত্তি । মাতৃ ভিন্ন অন্য ভাবের শক্তিপূজার কিছু কিছু মাত্রই অন্যান্য দেশে লক্ষিত হইয়া থাকে । বাস্তবিক জগৎকারণকে ‘মা’ বলিয়া ‘জগদম্বা’ বলিয়া ডাকা একমাত্ৰ ভারতেই দেখিতে পাওয়া যায় । আবার বহুকাল পবিত্র ও সংযত ভাবে শক্তিপূজার ফলে ভারতের ঋষিরাই প্রথম জ্ঞাত হইয়া প্রচার করিয়াছেন যে, জগদম্বা সগুণা এবং নিগুণা উভয়ই । পুরুষ ও প্ৰকৃতি, ব্ৰহ্ম ও মায়া বলিয়া ভারতের দর্শনকার যে দুই পদার্থ জগতের মূলে নির্দেশ করিয়াছেন, উহা একই বস্তুর একই কালে বিদ্যমান, দুই বিভিন্ন ভাব বা প্ৰকাশবিশেষ । তবে দেশকলাবচ্ছিন্ন বা নামরূপাবলম্বনে সবাহ্যান্তৰ্জগৎ-উপলব্ধিকারী মানবমন একই কালে, একেবারে জগদম্বার ঐ দুই ভাব সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষ করিতে অক্ষম । কারণ মানবমন স্বভাবতঃ এমন উপাদানে গঠিত যে, উহা আলোকান্ধকারের ন্যায় পরস্পরবিরুদ্ধ দুইটি ভাবকে একত্রে একই সময়ে গ্ৰহণে অপারগ । সেজন্য দেশ কালাবচ্ছিন্ন সগুণ ভাবের উপলব্ধির সময় সে জগদম্বার নির্গুণ ভাব উপলব্ধি করিতে পারে না ; এবং সমাধি সহায়ে উচ্চ ভূমিকায় আরোহণ করিয়া যখন সে জগন্মাতার নির্গুণ স্বরূপের প্ৰত্যক্ষ করে, তখন আর তাহার নয়নে তাহার সগুণ ভাবের ও সগুণ-ভাবপ্রসূত জগতের উপলদ্ধি হয় না । তবে সমাধিভূমি হইতে নামিয়া পুনরায় সাধারণভাব প্রাপ্ত হইলেও তাঁহার সমাধিকালানুভূত জগদম্বার নির্গুণ ভাবের যে কতকটা স্মৃতি থাকিয়া যায়, তাহাতেই সে নিঃসংশয় বুঝিতে পারে, তিনি নির্গুণা ও সগুণা উভয়ই । সে জন্য জগৎকারণের স্বরূপসম্বন্ধীয় পূর্ণ সত্য উপলব্ধি করিবার একমাত্র পথই যে নির্বিকল্প সমাধিলাভ, একথা ভারতের সকল ঋষি ও দর্শনকারই একবাক্যে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন ।

প্রতীকাবলম্বনে শক্তিপূজা যে ঐ সমাধিলাভের সহায়ক, একথাও ভারতের ঋষি ও আচার্যেরা আবহমানকাল হইতে নিজের উপলব্ধি করিয়া জনসাধারণে প্রচার করিয়া আসিতেছেন । প্রশ্ন উঠিতে পারে — প্ৰতীক কাহাকে বলে ? শাস্ত্রকার বলেন আন্তর ও বাহ্য জগতের অন্তর্গত যে সকল বিশেষ শক্তিশালী পদার্থ মানবমনে স্বভাবতঃ  অন্তরের ভাব উদিত করিয়া তাহাকে জগৎ কারণের অনুসন্ধান ও সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষকরণে নিযুক্ত করে, তাহাকেই প্ৰতীক বলে । আর ধাতু, প্রস্তর বা মৃত্তিকাদি কোন প্রকারেই পদার্থ গঠিত কৃত্ৰিম মূর্তিবিশেষে, জগৎকারণের সৃষ্টিস্থিত্যাদি গুণরাশির আরোপ বা আবেশ কল্পনা করিয়া পূজাধ্যানাদি-সহায়ে জগন্মাতার সাক্ষাৎ স্বরূপের উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করাকেই প্রতিমাপূজা বলে । “আব্ৰহ্মণি ব্ৰহ্মদৃষ্ট্যানুসন্ধানং” — অর্থাৎ যাহা সসীমস্বভাবহেতু পূৰ্ণব্ৰহ্ম নহে, ঐ প্রকার কোন পদাৰ্থ বা প্রাণীকে ব্ৰহ্ম বলিয়া ধরিয়া লইয়া পূৰ্ণব্ৰহ্মের স্বরূপানুভূতির চেষ্টা করার নামই প্রতীক ও প্রতিমাপূজা ।

আবার স্বল্প চিন্তার ফলেই প্ৰতীতি হইবে যে প্ৰত্যেক প্ৰতীক বা প্ৰতিমার পশ্চাতে সাধক চিরকাল জগৎকারণের গুণ বা শক্তিবিশেষেরই পরিচয় পাইয়া বা আরোপ করিয়া তাঁহার পূজা করিয়া আসিয়াছে । অতএব অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্তসাধকগণ অগণ্য দেব-দেবীর মূর্তি অবলম্বনে আবহমানকাল ধরিয়া কোনও না কোনও ভাবে যে শক্তিপূজাই করিয়া আসিয়াছে এবং এখনও যে তাহাই করিতেছে, এ বিষয় বুঝিতে আর বিলম্ব হয় না । বাস্তবিক সাধক জগৎকারণকে পুরুষ বা স্ত্রী যে ভাবেই গ্ৰহণ করুক না কেন, তাহার নিজ প্ৰকৃতিগত সংস্কারের অধীন হইয়াই উহা করিয়া থাকে এবং ঐ ভাবাবলম্বনে জগৎকারণের শক্তিরই পূজা করিয়া থাকে ।

যে কোনও ভাবাবলম্বনে যে কোন প্রতীকেই জগচ্ছক্তির উপাসনা করা হউক না কেন, উহাতে সাধকের মনের সম্পূর্ণ অনুরাগ না পড়িলে, সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না । ঐ সম্পূর্ণ অনুরাগ বা ভক্তিই তাহাকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সর্বপ্রকার ভোগসুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করাইয়া সর্বপ্রকার স্বার্থানুসন্ধানের হস্ত হইতে বিমুক্ত করিয়া দেয় । যে ভাবাবলম্বনেই সাধক সাধনায় প্ৰবৃত্ত হউক না কেন এবং সাধনে প্ৰবৃত্ত হইবার পূর্বে তাহার মনে যতই স্বার্থপরতা এবং ভোগসুখেচ্ছা থাকুক না কেন, কোনরূপে একবার তাহার মনে আপনি উপাস্যের উপর একবিন্দু যথার্থ অনুরাগ উপস্থিত হইলে, আর তাহার বিনাশ নাই । ঐ অনুরাগসহায়ে তাহার ঐ ভাবাঙ্কুর ধীরে ধীরে পুষ্ট ও বর্ধিত হইতে থাকে এবং ঐ ভাবসিদ্ধির জন্য কালে তাহাকে সম্পূর্ণ স্বার্থবলি বা আত্মবলি দিতে সক্ষম করে । জগৎকারণের সাক্ষাৎ প্ৰত্যক্ষের জন্য, প্ৰবল অনুরাগে, সর্বপ্রকার ভোগসুখ মন হইতে এককালে ঐরূপ ত্যাগ করাকে নানা দেশের ধর্মশাস্ত্ৰ নানাভাবে ও ভাষায় বৰ্ণনা করিয়াছেন । ঈশাহি ধর্মশাস্ত্ৰ বলিয়াছেন — ‘Death of the old man’ – পুরাতন মানবের মৃত্যু; ভারতের দার্শনিক বলিয়াছেন — ত্যাগ ও বৈরাগ্য-সাহায্যে মনের নাশ করা; তন্ত্রকার বলিয়াছেন - দেবীর সম্মুখে আত্মবলিদান দেওয়া; যোগী বলিয়াছেন - পূর্ণ একাগ্ৰতা বা চিত্তবৃত্তিনিরোধ । নানা জাতির ভিতর ঐরূপে ঐ একই মানসিক অবস্থা যে কত প্রকারে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা করা সুকঠিন ।

ভারতের ঋষি এবং আচার্যেরা আবার ভিন্ন ভিন্ন প্ৰকৃতি বা সংস্কারবিশিষ্ট সাধকের পক্ষে জগৎকারণের ভিন্ন ভিন্ন ভাবাশ্রয়ে উপাসনা ইষ্ট বলিয়া প্রচার করিয়া তাহাদের প্রত্যেকের ভাবসিদ্ধির জন্য ভিন্ন ভিন্ন মার্গের উপাসনা নির্দেশ করিয়াছেন । এক ভাবের উপযোগী মার্গবিশেষের উপাসনার সহিত অন্যভাবোপযোগী অন্য মার্গের উপাসনার বিশেষ প্ৰভেদ যে বিদ্যমান, একথা আর বুঝাইবার আবশ্যকতা নাই এবং তজ্জন্যই গ্ৰাম্যকথায় যেমন বলে – ‘যে বিবাহের যে মন্ত্র, তাহার উচ্চারণ চাই’ - অথবা সাধক যে ভাবসিদ্ধি-বাসনায় উপাসনায় বদ্ধপরিকর হইয়াছে, তদুপযোগী মাৰ্গেই তাহার অগ্রসর হওয়া কর্তব্য । নতুবা ফলসিদ্ধি সুদূরপরাহত থাকিবে । বৈষ্ণবতন্ত্রোক্ত সখ্য, বাৎসল্যাদি ভাবসিদ্ধির জন্য ৺কালীপূজা করিয়া বীরাচারে ভোগরাগাদির অনুষ্ঠানে কখনই ফলসিদ্ধি হইবে না । “গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ” — ইত্যাদি মন্ত্র পাঠই করিলাম অথচ গুরুকে সুখী করিতে যথাসাধ্য সেবা ও অর্থব্যয়ে কুণ্ঠিত হইলাম, “স্ত্রিয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু” - “হে দেবি তুমিই যাবতীয় স্ত্রীমূর্তিরূপে আপনি প্রকাশিতা হইয়া রহিয়াছ” - ইত্যাদি চণ্ডীতে লিপিবদ্ধ স্তবাদি পাঠ করিয়াই আবার পরক্ষণে মাতা, জায়া বা দুহিতার উপর নির্দয় ব্যবহার করিলাম ! - ঐরূপেও ভাবসিদ্ধি হইতে পারে না । এই প্রকার সর্বভাবসিদ্ধি সম্বন্ধেই বুঝিতে হইবে । অতএব আপন গন্তব্য পথে নিষ্ঠা রাখা, ভাবের ঘরে চুরি না করা এবং জগদম্বার স্বরূপ উপলব্ধির সহায় হইবে বলিয়া যে ভাবে যে প্রতীকই অবলম্বন করিয়া থাকি না কেন, ঐ প্রতীকটিই তিনি - অপর সকল বস্তু ও ব্যক্তি তিনি নহেন - এরূপ সঙ্কীর্ণ ভাব যাহাতে মনে উদয় না হয়, তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখা — এই কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া অগ্রসর হইলেই প্ৰতীকোপাসনা অশেষ মঙ্গলের হেতু হইয়া চরমে সাধককে সমাধি-ধনে ধনী করিয়া থাকে ।

আর এক কথা — আমাদের পূর্বোক্ত বক্তব্য বিষয় পাঠকের সহজে হৃদয়ঙ্গম হইবে বলিয়া আমরা পুস্তকের স্থলে স্থলে ব্যবহারিক জগতের ইতিহাস-প্ৰসিদ্ধ ঘটনাবলী প্রভৃতি দৃষ্টান্তরূপে প্রয়োগ করিয়াছি । বর্তমান সময়ের বিপ্লবাদীরা অনেক সময়ে ঐ রূপে ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের ভাষাবরণে আপনাদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করায় কেহ না ভাবিয়া বসেন - আমরাও তদ্রূপ করিয়াছি বা আমাদের তাহাদের সহিত কিছুমাত্ৰ সহানুভূতি আছে । তজ্জন্য এস্থলে স্পষ্ট বলিয়া রাখা ভাল যে অশ্রদ্ধা, হঠকারিতা, অবিবেচকতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতাতেই ঐ দলের জন্ম । রাজার মনে অনর্থক সন্দেহ উৎপাদন করিয়া উহারা ভারতের সমগ্র রাজভক্ত প্ৰজার সমূহ অকল্যাণ ও ক্ষতি সাধিত করিয়াছে; উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় দিয়া ভদ্রবংশীয় বালকদিগকে হীন দস্যুতস্করাদিতে পরিণত করিয়াছে; এবং ধর্মের ভাণে স্বাৰ্থসিদ্ধি করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়া সত্য ও সমাধিপূত গৈরিক বসনে জুয়াচুরির কলঙ্ককালিমা অর্পণেও কুষ্ঠিত হয় নাই । ইউরোপীয়দিগের ভিতর একটি প্ৰবাদ আছে যে, ‘শয়তানও স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করিয়া থাকে ।’ ইহাদের অধিকাংশের পর পর কাৰ্যকলাপ দেখিয়া সহানুভূতি হওয়া দূরে থাকুক, ঐ কথারই মনে উদয় হয় । বলা বাহুল্য, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অসত্য কখনও কোন কালে, ধর্ম দূরে থাকুক, কোনও বিষয়েই উন্নিতিলাভের সোপান হইতে পারে না । অলমতিবিস্তরেণ - ইতি


_________________________________________
Scanned Copy Sources :

১) স্বামী সারদানন্দ, 1959 : "গীতাতত্ত্ব ও ভারতে শক্তিপূজা", প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ১৯৫৯, প্ৰকাশক : ভোলানাথ দাস, সপ্তর্ষি, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০৭৩; মুদ্রক : প্রিন্টার্স কর্নার,  ৪৫/এ রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রীট, কলিকাতা-৭০০০০৯

২) স্বামী সারদানন্দ, 1923 : "ভারতে শক্তিপূজা", চতুর্থ সংস্করণ, প্ৰকাশক : স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা; মুদ্রক : শ্রীসুরেশচন্দ্র মজুমদার, শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস, ৭১/১ নং মির্জাপুর স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩২১২৩

৩) স্বামী সারদানন্দ, 1928 : "ভারতে শক্তিপূজা", পঞ্চম সংস্করণ, প্ৰকাশক : ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১ নং মুখার্জি লেন, কলকাতা; মুদ্রক : শ্রীশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, বাণী প্রেস, ৩৩/এ, মদন মিত্রের লেন, কলকাতা

1) "Gitatattwa O Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, November 1959. Published by Bholanath Das, Saptarshi, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Printer’s Corner, 45/A Raja Deenendra Street, Kolkata-700009.

2) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1923. Published by Swami Bishweshwarananda, Udbodhan Office, Kolkata. Printed by Sri Sureshchandra Majumdar, Sri Gouranga Press, 71/1 Mirzapur Street, Kolkata-732123.

3) "Bharote Shaktipuja" by Swami Saradananda, 1928. Published by Brahmochari Ganendranath, Udbodhan Office, 1 Mukherjee Lane, Kolkata. Printed by Sri Santakumar Chatterjee, Bani Press, 33/A Madan Mitra Lane, Kolkata.

Image Sources :
1) Cosmic Shakti
2) The Goddess

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned PDFs and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Next>